শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে চান রাকিবুলের বাবা-মা
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯:২১, ১৭ নভেম্বর ২০২৫
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় কার্যকর দেখতে চান রাকিবুলের বাবা-মা। ছবি: সংগৃহীত
ঝিনাইদহ শহরের শেষ প্রান্তে, শ্যাওলা জমে যাওয়া টিনের ঘরটার সামনে বিকেলের আলো ঠিকমতো পড়েও যেন থমকে থাকে। এই বাড়িটিই শহীদ রাকিবুল হোসেনের স্মৃতির শেষ আশ্রয়। আজ সেই ঘরেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে কথা বললেন তাঁর বাবা-মা—আবুবকর সিদ্দিক ও হাফিজা খাতুন।
‘আমি শুধু দেখতে চাই, আমার ছেলের খুনি ফাঁসির দড়িতে ঝুলছে’—হাফিজা খাতুন বয়সের ভারে শরীর নুয়ে গেছে, তবুও কথার ভেতর ছিল আগুনের দাহ।
হাফিজা খাতুন বললেন, ‘শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা রক্ষার জন্য ছাত্র–জনতাকে মারতে বলেছিল। আমার ছেলেকে ওরা বুকের মধ্যে গুলি মেরে শেষ করে দিল। আজ আদালত সত্যিটা প্রকাশ করেছে। এখন শুধু আল্লাহকে বলি, আমাকে বাঁচিয়ে রাখুক—যেন আমি চোখে দেখি, সেই রায় কার্যকর হচ্ছে।’
তারপর চুপ করে গেলেন। শুধু মাটিতে বসা রাকিবুলের পুরনো ব্যাগটা দু’হাত দিয়ে স্পর্শ করতে লাগলেন—যেন সময়ের ভেতর ফিরে যেতে চাইছেন।
শুধু পরিবার নয়, প্রতিবেশীরাও আজ স্মৃতিচারণ করছিলেন। রাকিবুলের শৈশববন্ধু আরিফুল ইসলাম বলেন, “রাকিবুল ছিল অদ্ভুত শান্ত ছেলে। কলেজে পড়ত, স্বপ্ন ছিল পুলিশ হবে। ঝগড়া-হাঙ্গামা এড়িয়ে চলত। ওই দিনে মিছিলে গিয়েছিল কারণ সবাই যাচ্ছিল, আর বলেছিল—‘দেশে অন্যায় হলে চুপ থাকা অন্যায়কে শক্তিশালী করা।’ সেই কথাটাই আজও কানে বাজে।”
প্রতিবেশী মনোয়ারা বেগম স্মরণ করলেন, ‘ছেলেটা বাড়িতে এলে গেট খুলে দিতো, সবার খোঁজ নিতো। এখনো গেটটা দেখি, মনে হয়—এই বুঝি রাকিবুল এসে দাঁড়াল।’
রাকিবুলের বাবা আবুবকর সিদ্দিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, ‘আজ রায় শুনে মনে হলো দেশের বিচারব্যবস্থা এখনও বেঁচে আছে। কিন্তু শুধু রায় হলে হবে না। শেখ হাসিনা, আসাদুজ্জামান খান কামাল—তাদের মতোই যারা বিদেশে পালিয়েছে, তাদের দেশে ফেরানো না গেলে ন্যায়বিচার সম্পূর্ণ হবে না।’
তিনি আরও যোগ করেন, ‘আমার ছেলে ২২ বছর বয়সে মারা গেল। আমি তখন থেকেই শুধু একটাই কথা বলেছি—দোষীরা যেন আইনের বাইরে না থাকে। আজ আদালতের রায় সেই আশ্বাস দিয়েছে।’
রাকিবুলের মৃত্যুর দিন: এক অস্থির জুলাই
স্থানীয়রা বলেন, ‘সেদিন দুপুরের পর দমবন্ধ করা অস্থিরতা ছিল চারপাশে। ঢাকার ঘটনাগুলো লাইভ দেখছিল সবাই। সন্ধ্যার আগেই খবর এল—ঝিনাইদহের একাধিক স্থানে গুলি, ধাওয়া, উত্তেজনা।’
আরিফুল বলেন, ‘বিকেল পাঁচটার দিকে শুনলাম কয়েকজনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে দেখি রাকিবুল শুয়ে আছে, চোখ-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। গুলিটা ছিল বুকের ডান পাশে। আমরা সবাই ভেঙে পড়েছিলাম।’
রাকিবুল যে মিছিলে হাঁটছিল, তার সামনে–পেছনে অনেক শিক্ষার্থী ছিলেন। কেউ কেউ এখনও মানসিকভাবে স্বাভাবিক হতে পারেননি। কলেজের শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, ‘তার মৃত্যু আমাদের এলাকায় এক যুগের ভরসা নিয়ে গেল। সবসময় মনে হয়—সামান্য এক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ভুলে কত মায়ের কোলে সন্তানহারা হতে হয়েছে।’
রাকিবুলের ঘরে এখনও বাতি জ্বলে
রায় ঘোষণার ঠিক পরেই তার বাড়ির ঘরটিতে গিয়ে দেখা যায়—রাকিবুলের জন্য রাখা একটি ছোট টেবিল ল্যাম্প এখনো জ্বলে থাকে। মা বলেন, ‘ওর আলো নিভে গেছে, কিন্তু আমরা ল্যাম্পটা নিভাই না। মনে হয়, ছেলে আমার এই ঘরে আছে।’
আজ সেই আলোয় মা–বাবার চোখের পানির সঙ্গে মিশে গেছে কিছুটা স্বস্তি, কিছুটা ন্যায়বিচারের অনুভূতি, আর অপেক্ষার দীর্ঘ পথ।
‘রায় হয়েছে, কিন্তু রায় কার্যকরের দিনটিই হবে আমাদের সত্যিকারের শান্তির দিন।’ ললেন আবুবকর সিদ্দিক।
