কোন দেশগুলো মৃত্যুদণ্ড বজায় রেখেছে, কারা তুলে দিয়েছে
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭:১২, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
ছবি: ফাইলফটো
বিশ্বের নানা প্রান্তে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কোন রাষ্ট্র এখনো এই শাস্তিকে কঠোর অপরাধ দমনের উপায় হিসেবে ধরে রেখেছে, আর কোন দেশ মানবাধিকার যুক্তি দিয়ে তা বাতিল করেছে—এই প্রশ্নের উত্তর দেশভেদে ব্যাপকভাবে বদলে যায়। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মৃত্যুদণ্ডের ব্যবহার কমে এলেও বেশ কিছু রাষ্ট্র এখনো নিয়মিতই এ সাজা কার্যকর করছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামায় একজন দণ্ডিত খুনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার করে—যা দেশটির ইতিহাসে প্রথম। একই সময়ে জাপানে আগুন লাগিয়ে ৩৬ জনকে হত্যার দায়ে একজন অপরাধীর ফাঁসি কার্যকর করেছে সরকার। আর বাংলাদেশে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এতে করে বৈশ্বিক পরিসরে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আলোচনা নতুন করে তীব্র হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউর সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিশ্বে এখনো অন্তত ৫৫টি দেশ বিভিন্ন অপরাধে মৃত্যুদণ্ড বৈধ রেখেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, নাইজেরিয়া, বাংলাদেশ, জাপান, মিসর, ইথিওপিয়া, ভিয়েতনাম, ইরান, মিয়ানমার, সৌদি আরব, সিরিয়া, উত্তর কোরিয়া, ইরাক, আফগানিস্তানসহ বহু রাষ্ট্র। এ দেশগুলোর অনেকগুলোতেই হত্যাকাণ্ড ছাড়াও মাদক–সংশ্লিষ্ট অপরাধ, রাষ্ট্রদ্রোহ, সন্ত্রাসবাদ কিংবা ধর্মীয় আইনভঙ্গের ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
অ্যামনেস্টির হিসাব অনুযায়ী, চীন এখনো বিশ্বের সর্বাধিক মৃত্যুদণ্ড কার্যকরকারী দেশ—যদিও দেশটি এ তথ্য প্রকাশ করে না। চীন ছাড়া ২০২২ সালে বিশ্বে মোট ৮৮৩টি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে, যা ২০১৭ সালের পর সর্বোচ্চ। ইরান, সৌদি আরব, মিসর ও যুক্তরাষ্ট্র মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সংখ্যায় শীর্ষে রয়েছে। মাদক–সংক্রান্ত অপরাধেও মৃত্যুদণ্ডের প্রবণতা বাড়ছে—শুধু ইরানেই ২০২২ সালে ২৫৫ জনকে মাদক মামলায় ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
এর বিপরীতে ধীরে ধীরে বাড়ছে মৃত্যুদণ্ড বাতিলকারী দেশের তালিকা। ২০২২ সালের হিসাব অনুযায়ী, ১১২টি দেশ মৃত্যুদণ্ড পুরোপুরি বা আংশিকভাবে বাতিল করেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাজাখস্তান, পাপুয়া নিউগিনি, সিয়েরা লিওন ও মধ্য আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র পুরোপুরি মৃত্যুদণ্ড বিলুপ্ত করেছে। মালয়েশিয়া বাধ্যতামূলক মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে, আর ঘানা সম্প্রতি এ শাস্তি তুলে দিয়েছে।
এ ছাড়া পশ্চিম ইউরোপের প্রায় সব দেশ, ল্যাটিন আমেরিকার বড় অংশ, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, তুরস্ক, মেক্সিকো, ফিলিপাইনসহ বহু দেশ দীর্ঘ আগে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলোর মতে, গত তিন দশকে এ প্রবণতা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে—১৯৯১ সালে যেখানে মাত্র ৪৮টি দেশ মৃত্যুদণ্ড কার্যকর বন্ধ করেছিল, এখন সেই সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি।
বর্তমানে বিশ্বে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের পদ্ধতিও দেশ অনুযায়ী ভিন্ন। সৌদি আরবে এখনো শিরশ্ছেদ পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়। যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, ভারত, বাংলাদেশসহ বহু দেশ ফাঁসি, প্রাণনাশী ইনজেকশন বা গুলিবর্ষণের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করে। আর যুক্তরাষ্ট্রে সম্প্রতি প্রথমবারের মতো নাইট্রোজেন গ্যাস ব্যবহার শুরু হয়েছে।
মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমাতে কার্যকর নয়; বরং এটি বহু দেশে রাজনৈতিক দমন বা পক্ষপাতমূলক বিচারের হাতিয়ার হয়ে ওঠে। তবে বিপরীত পক্ষের যুক্তি—কিছু অপরাধ এত ভয়াবহ যে সর্বোচ্চ শাস্তি ছাড়া বিকল্প নেই।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যানে স্পষ্ট হচ্ছে—বিশ্বজুড়ে মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হচ্ছে; কোথাও এটি কমছে, কোথাও আবার আগের মতো বা আরও কঠোরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানবাধিকার ও রাষ্ট্রের অপরাধদমন নীতির দ্বন্দ্ব তাই আরও দীর্ঘদিন বিশ্ব রাজনীতি ও বিচারব্যবস্থার কেন্দ্রেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে।
