মানবতাবিরোধী অপরাধ
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট মামলা ৫৯২, ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন ৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৪:২৬, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। আর পাঁচ বছর কারাদণ্ডাদেশ হয়েছে বাকি আসামি সাবেক পুলিশপ্রধান চৌধুরী আবদুল্লাহ আল–মামুনের।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) ৭৮ বছর বয়সী শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতে এই রায় হয়। অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে গত বছরের ৫ আগস্ট তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন। এখনো সেখানেই রয়েছেন। পলাতক থাকায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ তিনি পাচ্ছেন না বলে ট্রাইব্যুনালের কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন।
মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে জুলাই হত্যাকাণ্ড ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম মামলার রায় হলো। এ ছাড়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরও তিনটি মামলা চলছে ট্রাইব্যুনালে। আদালত অবমাননার দায়ে তাকে এই ট্রাইব্যুনাল এর আগে ছয় মাসের কারাদণ্ডও দিয়েছিলেন।
প্রথম মামলায় সোমবার উসকানিমূলক বক্তব্যের মাধ্যমে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। হেলিকপ্টার থেকে গুলিবর্ষণের নির্দেশসহ চানখাঁরপুল ও আশুলিয়া হত্যার অপরাধে তাকে দেওয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাওয়ার পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠন করেছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদণ্ডের রায়ও এসেছিল এই আদালত থেকে। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার এই আদালতে করতে ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে। সেই ট্রাইব্যুনালেই মৃত্যুদণ্ডের রায় পেলেন শেখ হাসিনা।
মোট মামলা ৫৯২
গত বছরের ৫ আগস্ট জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর এখন পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন আদালত ও থানায় ৫৮৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে। এছাড়া দুদকের মামলাও রয়েছে ছয়টি। সে হিসেবে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মোট মামলা দাঁড়িয়েছে ৫৯২টি।
এর মধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তিনটি মামলা বর্তমানে তদন্তাধীন।
পুলিশের তথ্যমতে, এসব মামলায় শেখ হাসিনাকে নির্দেশদাতা, হুকুমদাতা এবং পরিকল্পনাকারী হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, অপহরণ ও সহিংসতার অভিযোগ আনা হয়েছে।
এই ৫৮৬টি মামলার মধ্যে ৩২৪টি মামলা সরাসরি হত্যার অভিযোগে দায়ের করা হয়েছে।
দেশজুড়ে অভিযোগের পরিসর আরও বিস্তৃত— ঢাকা, ময়মনসিংহ, সিলেট ও কুষ্টিয়া-সহ বিভিন্ন জেলায় হত্যার পাশাপাশি হামলা, অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, চাঁদাবাজি ও দখলবাজির অভিযোগও অন্তর্ভুক্ত।
আরও অর্ধশত অভিযোগ জমা
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আরও অর্ধশতাধিক অভিযোগ জমা পড়েছে। পিরোজপুরের সুখরঞ্জন বালি, মাইকেল চাকমা, বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদসহ একাধিক বিএনপি নেতা এসব অভিযোগ করেছেন। এখন এগুলো যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়াধীন। তদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সত্যতা পাওয়ার পর এগুলোকে মামলা হিসেবে রূপান্তর করা হবে।
প্রথম মামলা গতবছরের ১৩ আগস্ট
ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকেই শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে নানা ধরণের মামলা দায়ের অব্যাহত রয়েছে। প্রথম মামলা দায়ের করা হয় গত বছর ১৩ আগস্ট, আবু সাঈদ হত্যার অভিযোগে মোহাম্মদপুর থানার পুলিশ কর্মকর্তার মাধ্যমে।
পুলিশের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের পর সারাদেশে ১,৬১২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৫৯৯টি হত্যা মামলা এবং বাকি এক হাজার তিনটি অন্যান্য অভিযোগ।
প্রথম সাজা ছিল ৬ মাসের কারাদণ্ড
আদালত অবমাননার একটি মামলায় গত ২ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছেন।
‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’—শেখ হাসিনার এমন একটি বক্তব্যের অডিও রেকর্ড অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে। তার ওই বক্তব্য বিচার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা উল্লেখ করে প্রসিকিউশন আদালত অবমাননার অভিযোগ আনে। সেই মামলায় শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল।
আরও ৩ মামলা ট্রাইব্যুনালে
শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের আরও তিনটি মামলা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে রয়েছে। এর মধ্যে গুমের দুটি মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। আর শাপলা চত্বর হত্যা মামলাটি তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের অপেক্ষায় রয়েছে।
গুমের দুই মামলা
চলতি বছরের ৮ অক্টোবর বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আলোচিত গুমের ঘটনায় প্রথমবারের মতো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৮ জনের বিষয়ে দুটি ফরমাল চার্জ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
ওইদিন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, গুম, গোপন বন্দিশলায় আটক, নির্যাতন, হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের যে অপরাধ হয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে এই প্রথম দুটি ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। সেই ফরমাল চার্জ উপস্থাপন করেছি। ট্রাইব্যুনাল সবগুলোর বর্ণনা শুনেছেন। এরপর আসামিদের বিরুদ্ধে কগনাইজেন্স নিয়েছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ইস্যু করেছেন।
দুটি অভিযোগের মধ্যে একটি হলো গত ১৫ বছরে র্যাবের কিছু বিপদগামী সদস্য টিএফআই সেল এবং বিভিন্ন গোপন বন্দিশালায় ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক কর্মী, সাংবাদিক, ব্লগারকে আটক রেখে নির্যাতন করা হয়েছে।
এ সমস্ত হাজারো অভিযোগের মধ্য থেকে যেগুলো ইতোমধ্যে প্রমাণিত হয়েছে সেগুলোর ব্যাপারে ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে।
এর বাইরে ডিজিএফআইয়ের কিছু বিপদগামী সদস্য যারা জেআইসি নামক যে সেন্টারটি আছে সেটিকে অপব্যবহার করে রাজনৈতিক বা অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের আটক রেখেছিল। সেটার ব্যাপারে আলাদা ফরমাল চার্জ দাখিল করা হয়েছে। এ ঘটনার সঙ্গে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকীসহ র্যাব ও ডিজিএফআইয়ের বেশ কিছু অফিসার যারা আসামি তাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এরপর ১৭ নভেম্বর এই দুই মামলার কয়েকজন আসামি সেনা কর্মকর্তারা আদালতে হাজির হন। পরে আদালত তাদের কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এই দুটি মামলার পরবর্তী শুনানি ২৩ নভেম্বর।
শাপলা চত্বর হত্যাকাণ্ড
২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর অভিযোগ করেন হেফাজতে ইসলামের নেতা আজিজুল হক। হেফাজত নেতা জুনায়েদ আল-হাবিব ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে তিনি এ অভিযোগ করেন। এ ঘটনায় ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।
তারা হলেন- সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস, সাবেক মন্ত্রী হাছান মাহমুদ, সাবেক এমপি হাজি সেলিম, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, নারায়ণগঞ্জের সাবেক এমপি শামীম ওসমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী, সাবেক আইজিপি একেএম শহীদুল হক, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, র্যাবের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জিয়াউল আহমেদ, ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) হারুন অর রশীদ, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির, কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সাবেক প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ, গণজাগরণ মঞ্চের আহ্বায়ক ইমরান এইচ সরকার, একাত্তর টিভির সাবেক সিইও মোজাম্মেল হক বাবু, সময় টিভির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আহমেদ জোবায়ের, এবিনিউজ২৪ ডটকমের সম্পাদক সুভাষ সিংহ রায়, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান, সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদ ও এনএসআইয়ের মো. মনজুর আহমেদ।
১২ নভেম্বর এ মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়িয়ে ১২ জানুয়ারি নির্ধারণ করা হয়েছে।
বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন
বর্তমান সরকারের জুলাই আন্দোলনে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না। তিনি বলেন, যদি ভবিষ্যতে রাজনৈতিক পরিস্থিতি পরিবর্তিত হয় এবং আওয়ামী লীগ পুনরায় ক্ষমতায় আসে, তাহলে এই রায়ের প্রভাব নাও থাকতে পারে। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টার পদে দায়িত্ব নেওয়ার পর তার বিরুদ্ধে থাকা সব মামলা বাতিল হয়ে গিয়েছিল। সাজা হলো বা হলো না, আমার কাছে এই বিচার বিশেষ গুরুত্বের নয়।
সর্বশেষ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও সোমবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিচার ‘সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত কোনোটিই হয়নি’ বলে মত জানিয়েছে।
অ্যামনেস্টির মহাসচিব অ্যাগনেস কালামার্ড বলেন, ‘২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন বিক্ষোভের সময় যে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ রয়েছে, সে জন্য যারা ব্যক্তিগতভাবে দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ায় তদন্ত ও বিচারকাজ হতে হবে। কিন্তু এই বিচার ও সাজা কোনোটিই সুষ্ঠু ও ন্যায়সংগত হয়নি। ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি পাওয়া দরকার। অথচ মৃত্যুদণ্ড মানবাধিকার লঙ্ঘনকে আরও বাড়িয়ে তোলে। এটি সবচেয়ে নিষ্ঠুর, অমানবিক ও অবমাননাকর শাস্তি। কোনো ন্যায়বিচার ব্যবস্থায় এর (মৃত্যুদণ্ডের) স্থান নেই।’
