শেষ আশা হারালেন আফগান নারীরা
বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭:৪৮, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ছবি : সংগৃহীত
ফাহিমা নূরী যখন আফগানিস্তানের এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেছিলেন, তখন তার অনেক স্বপ্ন ছিল। তিনি আইন অধ্যয়ন করেছেন, ধাত্রীবিদ্যা (মিডওয়াইফারি) প্রোগ্রাম শেষ করেছেন এবং মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও কাজ করেছেন।
কিন্তু ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর তার সবকিছুই কেড়ে নেওয়া হয়। ১২ বছরের বেশি বয়সী মেয়েদের জন্য শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়, নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কঠোরভাবে সীমিত করা হয় এবং সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীদের লেখা বই সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
ফাহিমার জন্য ইন্টারনেটই ছিল বাইরের বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার শেষ ভরসা।
তিনি বলেন,“আমি সম্প্রতি একটি অনলাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আশা ছিল পড়াশোনা শেষ করে অনলাইনে চাকরি খুঁজে নেব। কিন্তু মঙ্গলবার তালেবান দেশব্যাপী অনির্দিষ্টকালের জন্য ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। আমাদের শেষ আশা ছিল অনলাইন শিক্ষা। এখন সেই স্বপ্নও ধ্বংস হয়ে গেছে।”
আমরা সবাই ঘরে বসে আছি, কিছুই করছি না
গত কয়েক সপ্তাহে তালেবান বিভিন্ন প্রদেশে ফাইবার-অপটিক ইন্টারনেট লাইন কেটে দিতে শুরু করেছিল, অজুহাত দেখানো হয়েছিল যে এটি অনৈতিক কাজ ঠেকানোর জন্য। অনেকেই তখন আশঙ্কা করেছিলেন, এটি আসন্ন পূর্ণ ইন্টারনেট নিষেধাজ্ঞার প্রথম ধাপ।
অবশেষে মঙ্গলবার সেটাই সত্যি হলো। ইন্টারনেট নজরদারি সংস্থা নেটব্লকস জানিয়েছে, দেশ এখন “সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউট”-এর মধ্যে রয়েছে। এতে দেশের জরুরি সেবাগুলো প্রায় অচল হয়ে পড়েছে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থাগুলোও রাজধানী কাবুলের দপ্তরগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট এবং স্যাটেলাইট টিভি পরিষেবা ভীষণভাবে ব্যাহত হয়েছে। এমনকি কাবুল বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইটও ব্যাহত হয়েছে বলে স্থানীয় গণমাধ্যম জানাচ্ছে।
তাহার প্রদেশের শাকিবা বলেন,“আগে আমি ধাত্রীবিদ্যা পড়তাম। কিন্তু সেই প্রোগ্রাম নারীদের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়। শেষ আশা ছিল ইন্টারনেট আর অনলাইন শিক্ষা। আমরা পড়াশোনা করতে চাই, শিক্ষিত হতে চাই, ভবিষ্যতে মানুষের উপকার করতে চাই। যখন শুনলাম ইন্টারনেট কেটে দেওয়া হয়েছে, মনে হলো পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেছে।”
পূর্বাঞ্চলে বসবাসকারী ফাহিমা জানান, তিনি ও তার দুই বোন অনলাইনে পড়াশোনা করতেন।
“আমরা খবর, প্রযুক্তি, নতুন দক্ষতা সবই ইন্টারনেটের মাধ্যমে জানতাম। এখন আর কিছুই শিখতে পারছি না। আমরা চেয়েছিলাম পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে আর্থিকভাবে সাহায্য করব। কিন্তু এখন... আমরা সবাই ঘরে বসে কিছুই করছি না।”
শিক্ষা, কাজ ও জীবিকার ক্ষতি
তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর থেকে নারীদের জন্য ধারাবাহিকভাবে নানা বিধিনিষেধ জারি করছে। এ মাসেই তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নারীদের লেখা বই সরিয়ে দিয়েছে। মানবাধিকার ও যৌন হয়রানি বিষয়ক শিক্ষাদানও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। প্রায় ১৪০টি বই, এমনকি “সেফটি ইন দ্য কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি” নামক বইও “শরিয়াবিরোধী” বলে বাদ দেওয়া হয়েছে।
শুধু ছাত্রীরাই নয়, শিক্ষক ও পেশাজীবীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পূর্বাঞ্চলের শিক্ষক জাবি অনলাইনে ইংরেজি শেখাতেন।
“আমার ক্লাসে ৭০-৮০ জন ছাত্রছাত্রী ছিল। সবাই আইইএলটিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। রিসার্চ, প্র্যাকটিস টেস্ট, পরীক্ষার সবকিছুই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভর করত। দুই দিন আগে প্রায় ৪৫ জন শিক্ষার্থী অনলাইন পরীক্ষার মাঝপথে ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তারা মাসের পর মাস প্রস্তুতি নিয়েছিল। সুযোগ হাতছাড়া হলো। শিক্ষক হিসেবে আমার জন্যও এটা ছিল হৃদয়বিদারক।”
তিনি বলেন, ছাত্ররা এখনো ফোন করে জিজ্ঞেস করছে, “স্যার, কী করব?” ছেলেদের জন্য কিছু ইংরেজি সেন্টার খোলা থাকলেও মেয়েদের জন্য এটিই ছিল শেষ সুযোগ।
ব্যয়বহুল বিকল্প ও অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ
যদিও মোবাইল ডেটা ব্যবহার করা সম্ভব, কিন্তু তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সংযোগও স্থিতিশীল নয়। ১০০ জিবির মাসিক প্যাকেজের খরচ ৩,৫০০ আফগানি (প্রায় ৫০ ডলার), যেখানে আগের ওয়াই-ফাই খরচ ছিল প্রায় ১,০০০ আফগানি এবং তা কয়েকজন মিলে ভাগাভাগি করা যেত।
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২৪ সালে আফগানিস্তানের মাথাপিছু আয় মাত্র ৩০৬ ডলার।
জাবি বলেন, ইন্টারনেট চালু না হলে তাকে দেশ ছাড়তে হবে, কারণ জীবিকা নির্বাহের আর কোনো উপায় নেই।একইভাবে, টাকা বদলানো ব্যবসায়ী আনাস জানান, ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তার ব্যবসা ৯০% ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু তার প্রধান দুশ্চিন্তা তার তিন মেয়ে—যারা অনলাইনে পড়াশোনা করছিল।
ইন্টারনেট কেটে দেওয়ার খবর শোনার পর আমার মেয়ে কাঁদছিল। তাদের পড়াশোনার শেষ সুযোগও শেষ হয়ে গেল। সন্তানদের এতটা অসহায় দেখতে পাওয়া ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের অভিজ্ঞতা।
মূল : প্রতিবেদন বিবিসি
অনুবাদ : সমাজকাল