অস্ত্রোপচার ছাড়াই ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন যুগ আনছে আলট্রাসাউন্ড
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:৪২, ৯ অক্টোবর ২০২৫

একসময় শুধুমাত্র দেহের ভেতর দেখার প্রযুক্তি হিসেবে ব্যবহৃত হতো আলট্রাসাউন্ড। কিন্তু এখন এই একই শব্দতরঙ্গ প্রযুক্তি ক্যান্সারের চিকিৎসায় আনছে বিপ্লব। অস্ত্রোপচার ছাড়াই ক্যান্সার টিউমার ধ্বংসে এটি খুলে দিয়েছে নতুন এক অধ্যায়।
২০০০ সালের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণারত অবস্থায় তরুণ গবেষক জেন সু খুঁজছিলেন এমন এক প্রযুক্তি, যা দিয়ে শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যু অস্ত্রোপচার ছাড়াই সরানো যাবে।
তিনি পরীক্ষা করছিলেন উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দতরঙ্গ, অর্থাৎ আলট্রাসাউন্ড— যা টিস্যুকে ভেঙে ফেলতে সক্ষম। সহকর্মীরা যখন পরীক্ষাগারে উচ্চ শব্দের অভিযোগ তুললেন, সু পালসের হার বাড়িয়ে শব্দের পরিমাণ কমিয়ে দিলেন।
অবিশ্বাস্যভাবে দেখলেন— এতে টিস্যু ধ্বংসের কার্যকারিতা বেড়ে গেছে। মাত্র এক মিনিটে শুকরের হৃদযন্ত্রে তৈরি হলো একটি গর্ত। এখান থেকেই জন্ম নেয় বিপ্লবী প্রযুক্তি “হিস্টোট্রিপসি
কীভাবে কাজ করে ‘হিস্টোট্রিপসি’
হিস্টোট্রিপসিতে আলট্রাসাউন্ড তরঙ্গ একটি নির্দিষ্ট ক্ষুদ্র এলাকায় (প্রায় ২×৪ মিমি) একত্রিত হয়।
এই তরঙ্গ ক্ষুদ্র মাইক্রোবাবল তৈরি করে, যা দ্রুত বিস্তৃত ও ধসে পড়ে টিউমার টিস্যু ছিন্নভিন্ন করে ফেলে।
এরপর শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউন সিস্টেম স্বাভাবিকভাবে ওই কোষাবশেষ সরিয়ে ফেলে।
পুরো প্রক্রিয়াটি অবেদনহীন, বিষমুক্ত ও অস্ত্রোপচারবিহীন, এবং অধিকাংশ রোগী একই দিনে হাসপাতাল ছেড়ে বাড়ি ফিরতে পারেন।
২০২৩ সালের অক্টোবরে মার্কিন ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) লিভার ক্যান্সার চিকিৎসায় হিস্টোট্রিপসির অনুমোদন দেয়।
২০২৪ সালে প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা যায়, এটি ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে সফলভাবে টিউমার ধ্বংস করতে সক্ষম।
২০২৫ সালে যুক্তরাজ্যও এটি অনুমোদন করে এবং এনএইচএস এর আওতায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু করে।
আলট্রাসাউন্ডের অন্য ব্যবহার: এইচআইএফইউ প্রযুক্তি
এর আগে থেকেই চিকিৎসা জগতে ছিল হাই ইনটেসনিটি পোকাসড আলট্রা সাউন্ড প্রযুক্তি, যা তাপ সৃষ্টি করে টিউমার ‘রান্না’ করে ধ্বংস করে।বিশেষ করে প্রোস্টেট ক্যান্সার চিকিৎসায় এটি অস্ত্রোপচারের বিকল্প হিসেবে সফলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।তবে হিস্টোট্রিপসির বড় সুবিধা হলো— এটি তাপ উৎপন্ন করে না, ফলে পার্শ্ববর্তী সুস্থ টিস্যু ক্ষতির ঝুঁকি কম।
আলট্রাসাউন্ড ও ওষুধের যুগল প্রয়োগ
সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আলট্রাসাউন্ড ও মাইক্রোবাবল একসঙ্গে প্রয়োগ করলে ক্যান্সার চিকিৎসায় ওষুধ পৌঁছানো আরও কার্যকর হয়।
এতে ব্লাড-ব্রেইন ব্যারিয়ার সাময়িকভাবে খোলা যায়, ফলে মস্তিষ্কের ক্যান্সারেও ওষুধ পৌঁছানো সম্ভব হয়।
কানাডার সানিব্রুক হেলথ সায়েন্স সেন্টার-এর গবেষক দীপা শর্মা বলেন, “এই পদ্ধতিতে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মাত্রা কমিয়েও একই ফল পাওয়া সম্ভব— ফলে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া অনেক কম।”
ইমিউনোথেরাপির সঙ্গে সম্ভাবনা
আলট্রাসাউন্ড টিউমার টিস্যুকে ইমিউন সিস্টেমের কাছে দৃশ্যমান করে তোলে— ফলে শরীর নিজেই ক্যান্সার কোষের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারে।
গবেষক রিচার্ড প্রাইস আশা করছেন, ভবিষ্যতে এমন চিকিৎসা সম্ভব হবে যেখানে এক টিউমার ধ্বংসের মাধ্যমে শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা বহু টিউমারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে।
যদিও গবেষণা এখনও চলমান, বিজ্ঞানীরা বলছেন— আলট্রাসাউন্ড চিকিৎসা ভবিষ্যতে ক্যান্সার চিকিৎসার ধরন পাল্টে দিতে পারে।
অস্ত্রোপচার, কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপির মতো কঠিন চিকিৎসার জায়গায় এটি আনবে এক দ্রুত, ব্যথাহীন ও মানবিক বিকল্প।
প্রফেসর জেন সু বলেন,“ক্যান্সার ভয়াবহ, কিন্তু আরও ভয়াবহ হলো এর চিকিৎসা। আমি চাই, আলট্রাসাউন্ড প্রযুক্তি সেই কষ্ট কমিয়ে দিক।”সূত্র; বিবিসি