এক অবাক করা পরীক্ষা : দই বানাল পিঁপড়া!
বিজ্ঞান ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭:০৬, ৭ অক্টোবর ২০২৫

বিজ্ঞান আর রান্নার মেলবন্ধনে নতুন এক কাণ্ড ঘটেছে ডেনমার্কে। কোপেনহেগেনের দুই-মিশেলিন তারকা রেস্টুরেন্ট এলকেমিস্ট এ পরিবেশিত হয়েছে এক অদ্ভুত খাবার—পিঁপড়ার দই!
এই দই কেবল রন্ধনশৈলীর এক বিস্ময় নয়, বরং মাইক্রোবায়োলজির ক্ষেত্রেও এক যুগান্তকারী অনুসন্ধান।
গবেষণার মূল অনুপ্রেরণা এসেছিল এক দৈনন্দিন দুর্ঘটনা থেকে।এক শেফ যখন ফ্রিজে রাখা দুধে একটি পিঁপড়া ঢুকে পড়ে, তখন দেখা যায় দুধটি টক হয়ে দইয়ের মতো ঘন হয়ে গেছে। এখান থেকেই শুরু হয় এলকেমিস্ট দলের ‘ant-ics’—অর্থাৎ পিঁপড়া-নির্ভর ফারমেন্টেশন গবেষণা।
গবেষণার পেছনের গল্প
এই অভিনব গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন নাবিলা রদ্রিগেজ ভালেরন, ড্যানিশ ফুডটেক কোম্পানি Summ Ingredients (পূর্বে Nutrumami)-এর ফ্লেভার ফারমেন্টেশন প্রধান এবং এলকেমিস্ট এর সাবেক বিজ্ঞানী।
তার সঙ্গে ছিলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞানী ড. ভেরোনিকা মেরি সিনোট এবং জার্মানির মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী সেভগি মুতলু সিরাকোভা।
তারা খুঁজে পান, ইউরোপের বুলগেরিয়ায় পুরোনো একটি প্রথা আছে—রেড উড অ্যান্ট (Red Wood Ant) ব্যবহার করে দই তৈরি করা। সেই ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করতেই দলটি যায় বুলগেরিয়ার নোভা মাহালা গ্রামে, যেখানে স্থানীয়রা এখনো এই প্রক্রিয়ার কিছু অংশ মনে রেখেছেন।
কীভাবে তৈরি হলো পিঁপড়ার দই
প্রক্রিয়াটি ছিল একেবারেই প্রাচীন ধাঁচের।
গরুর দুধ গরম করে একটি কাচের জারে ঢালা হয়, তাতে চারটি জীবিত পিঁপড়া যোগ করা হয়। এরপর জারটি কাপড় দিয়ে ঢেকে পিঁপড়ার কলোনির ভেতর পুঁতে রাখা হয়।
২৪ ঘণ্টা পর দেখা গেল দুধ ঘন হয়ে গেছে, টক-মিষ্টি গন্ধ আর হালকা দইয়ের মতো টেক্সচার।
সিনোট বলেন, “স্বাদে টক, লেবুর মতো টান, কিন্তু কিছুটা জটিল—একেবারে ল্যাকটিক অ্যাসিড ব্যাকটেরিয়ার মতো প্রভাব।”
পরীক্ষায় দেখা গেছে, জীবিত পিঁপড়া দুধে ল্যাকটিক অ্যাসিড ও অ্যাসেটিক অ্যাসিড উৎপন্ন করে, যা দুধকে প্রাকৃতিকভাবে ঘন করে তোলে।
মৃত বা শুকনো পিঁপড়া এ কাজ করতে পারে না—বরং সেখানে ক্ষতিকর Bacillaceae পরিবারের ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে।
খাবারে ব্যবহার: ‘Ant-wich’ আইসক্রিম থেকে ককটেল
এলকেমিস্ট ৎ রেস্টুরেন্টের গবেষক ও রন্ধনশিল্পীরা এরপর তিনটি পদ তৈরি করেন—
১. এন্টইউচি আইসক্রিম: পিঁপড়া-ফারমেন্টেড ভেড়ার দুধের দই দিয়ে তৈরি আইসক্রিম, যার ভেতর ছিল পিঁপড়া-জেল ও পিঁপড়া আকৃতির কুকি।
২. এন্ট ম্যাকারপোন: ছাগলের দুধে ডিহাইড্রেটেড পিঁপড়া দিয়ে বানানো ক্রিম চিজ, যার স্বাদ ছিল পরিপক্ব পেকোরিনো চিজের মতো।
৩. এন্ট ওয়াশড কোকটেইল : সাধারণত সাইট্রাস দিয়ে দুধ জমিয়ে তৈরি ককটেলে এবার জমাট বাঁধার কাজ করেছে পিঁপড়ার অ্যাসিড। এতে ছিল ব্র্যান্ডি ও অ্যাপ্রিকট লিকার—ফলাফল, “অবিশ্বাস্যভাবে সিল্কি” পানীয়।
এই “এন্ট-উইচ” আইসক্রিম প্রায় এক বছর ধরে রেস্টুরেন্টে পরিবেশন করা হয় এবং অতিথিরা তা “ভীষণ উপভোগ্য” বলে মন্তব্য করেছেন।
গবেষকরা বলছেন, এই গবেষণা শুধু এক অভিনব খাবারের কাহিনি নয়—এটি প্রমাণ করছে পোকামাকড়ও প্রাকৃতিক ফারমেন্টেশনের উপাদান হতে পারে।
ড. চ্যাংকি লিউ (সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটি) বলেন, “এই গবেষণা দেখাচ্ছে, পোকামাকড় কেবল প্রোটিন উৎস নয়, তারা খাদ্য তৈরির প্রক্রিয়াও বদলে দিতে পারে।”
এছাড়া প্রথাগত ফারমেন্টেশনের বৈচিত্র্য নিয়ে নাবিলা ভালেরন বলেন, “একক ব্যাকটেরিয়া নয়, বরং বহু মাইক্রোবের মিশ্রণই খাদ্যকে স্বাস্থ্যকর ও হজমযোগ্য করে।”
‘এটা ঘরে বানাবেন না’
গবেষকরা পরিষ্কারভাবে সতর্ক করেছেন—এই দই ঘরে বানানো বিপজ্জনক হতে পারে।
কারণ ইউরোপীয় রেড উড অ্যান্টে থাকে Dicrocoelium dendriticum নামের এক পরজীবী, যা মানুষের জন্য মারাত্মক।
তারা পরীক্ষাগারে ফিল্টার দিয়ে দুধ ছেঁকে জীবাণু রেখেছেন, কিন্তু পরজীবী বাদ দিয়েছেন।
তবে সাধারণভাবে ঘরে তা করা সম্ভব নয়, ফলে খাদ্যবাহিত রোগের ঝুঁকি তৈরি হবে।
পিঁপড়ারা বিপন্ন প্রজাতি—তবু তাদের মাইক্রোব উপকারী
ইউরোপীয় রেড উড অ্যান্ট এখন IUCN Red List-এ ‘নিয়ার-থ্রেটেনড’ প্রজাতি।
তাই গবেষকরা জানাচ্ছেন, “পিঁপড়াকে ব্যাপক হারে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়, তবে তাদের শরীরের মাইক্রোবগুলো আলাদা করে শিল্প পর্যায়ে নিরাপদভাবে ব্যবহার করা যেতে পারে।”
এই গবেষণা শুধু ‘পিঁপড়া দই’ নয়—বরং নতুন ধরনের ফারমেন্টেশন প্রযুক্তির সম্ভাবনা খুলে দিয়েছে।
সাওয়ারডো, মিসো, সয়া সসের মতো খাবারে যেমন বহু মাইক্রোব মিলে কাজ করে, পিঁপড়ার দইও তেমনি এক ‘জীবন্ত কমিউনিটি ফারমেন্টেশন’-এর উদাহরণ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ভবিষ্যতের খাদ্যশিল্পে বহু প্রজাতির মাইক্রোব ব্যবহার করে প্রাকৃতিক ফারমেন্টেশনই হবে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর, টেকসই ও সৃজনশীল পথ।
সূত্র : সিএনএন বিজ্ঞান বিভাগ