প্রথমবারের মতো মানুষের ত্বকের ডিএনএ থেকে ভ্রূণ তৈরি
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬:৫২, ১ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ০২:১৮, ২ অক্টোবর ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মানুষের ত্বকের কোষ থেকে নেওয়া ডিএনএ ব্যবহার করে প্রাথমিক স্তরের মানব ভ্রূণ তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন এবং সেটিকে শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত করেছেন।
এই প্রযুক্তি বয়সজনিত বা রোগজনিত বন্ধ্যাত্ব কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে, কারণ শরীরের প্রায় যেকোনো কোষকে জীবনের সূচনাবিন্দু হিসেবে ব্যবহার করা সম্ভব। এমনকি একই লিঙ্গের দম্পতিদেরও জেনেটিকভাবে সম্পর্কিত সন্তান লাভের পথ খুলে দিতে পারে এটি।
তবে এখনো এই পদ্ধতিকে নিখুঁত করতে বহু সময় (প্রায় এক দশক) লাগতে পারে, তার আগে কোনো ক্লিনিকে এটি ব্যবহার শুরু করা সম্ভব হবে না। বিশেষজ্ঞরা একে চমকপ্রদ অগ্রগতি বলেছেন, তবে একই সঙ্গে এ ধরনের গবেষণা নিয়ে জনসাধারণের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলেছেন।
কিভাবে কাজ করে এই পদ্ধতি
প্রজননের প্রাচীন ধারা ছিল সহজ—পুরুষের শুক্রাণু ও নারীর ডিম্বাণুর মিলনে ভ্রূণ তৈরি হয়, এবং নয় মাস পরে জন্ম হয় শিশুর। এখন বিজ্ঞানীরা সেই নিয়ম নতুনভাবে লিখছেন।
ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির (ওএইচএসইউ) গবেষণা দল ত্বকের কোষের নিউক্লিয়াস (যেখানে সম্পূর্ণ জেনেটিক কোড থাকে) সংগ্রহ করে সেটিকে এক দাতা ডিম্বাণুর ভেতরে স্থাপন করেছেন, যে ডিম্বাণুর নিজস্ব জেনেটিক তথ্য মুছে ফেলা হয়েছিল।
এখন পর্যন্ত প্রক্রিয়াটি ডলি নামের ভেড়ি তৈরির (১৯৯৬ সালে প্রথম ক্লোন স্তন্যপায়ী) প্রযুক্তির মতো। তবে এখানে সমস্যা হলো, ডিম্বাণুর মধ্যে ইতোমধ্যেই পূর্ণ ৪৬টি ক্রোমোজোম থাকে। নতুন নিউক্লিয়াস যোগ করার পর এটিকে আবার "সাধারণ ডিম্বাণু"র মতো আচরণ করাতে বিজ্ঞানীরা তৈরি করেছেন নতুন একটি প্রক্রিয়া— মাইটো-মিয়োসিস। এতে ডিম্বাণু নিজের অর্ধেক ক্রোমোজোম ফেলে দেয়, যেন মানুষের প্রজননের মতো ২৩+২৩ ক্রোমোজোমে মিলন ঘটে।
এইভাবে ৮২টি কার্যকর ডিম্বাণু তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এগুলোকে শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত করা হলে কিছু ভ্রূণ প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত গঠিত হয়েছে, যদিও কোনোটিই ছয় দিনের বেশি বাড়তে দেওয়া হয়নি।
গবেষক দলের প্রধান প্রফেসর শৌখরাত মিতালিপভ বলেছেন, “আমরা এমন কিছু করতে পেরেছি যা একসময় অসম্ভব মনে করা হতো।”
তবে এখনো এটি অত্যন্ত প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। ডিম্বাণু এলোমেলোভাবে ক্রোমোজোম ফেলে দিচ্ছে—যার ফলে কিছু ক্ষেত্রে একই ধরনের দুইটি ক্রোমোজোম থেকে যাচ্ছে, আবার কিছু একেবারেই অনুপস্থিত হচ্ছে। সফলতার হারও খুব কম (প্রায় ৯%)।
এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ জিন পুনর্বিন্যাস ঘটছে না, যা জেনেটিক রোগ প্রতিরোধে অপরিহার্য।
এই প্রযুক্তি in vitro gametogenesis (শরীরের বাইরে শুক্রাণু বা ডিম্বাণু তৈরির প্রক্রিয়া)-এর অংশ। লক্ষ্য হলো এমন দম্পতিদের সাহায্য করা, যাদের আইভিএফ-এও (আইভিএফ) সফলতা আসে না, কারণ তাদের কার্যকর ডিম্বাণু বা শুক্রাণু নেই।
এটি কাজে লাগতে পারে
বয়স্ক নারীদের জন্য, যাদের ডিম্বাণু আর সক্রিয় নেই
এমন পুরুষদের জন্য, যাদের যথেষ্ট শুক্রাণু উৎপাদন হয় না
ক্যানসার চিকিৎসায় বন্ধ্যাত্বে আক্রান্ত ব্যক্তিদের জন্য
সবচেয়ে আলোচিত সম্ভাবনা হলো একই লিঙ্গের দম্পতিদের জেনেটিকভাবে সম্পর্কিত সন্তান জন্ম দেওয়া। যেমন, দুই পুরুষের দম্পতির ক্ষেত্রে একজনের ত্বক থেকে তৈরি ডিম্বাণু অপরজনের শুক্রাণুর মাধ্যমে নিষিক্ত হতে পারে।
প্রফেসর পাওলা আমাতো বলেছেন, “এটি শুধু লাখো বন্ধ্যাত্ব সমস্যায় ভোগা মানুষকেই আশা দেবে না, একই সঙ্গে একই লিঙ্গের দম্পতিদের জন্যও সন্তান লাভের নতুন সুযোগ তৈরি করবে।”
হাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রজনন চিকিৎসার অধ্যাপক রজার স্টার্মে বলেন, “এই বিজ্ঞান গুরুত্বপূর্ণ এবং চিত্তাকর্ষক। কিন্তু একই সঙ্গে এ ধরনের গবেষণা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জনসাধারণের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনার প্রয়োজন আছে, এবং এর জন্য দৃঢ় আইন-কানুন ও নৈতিক দিকনির্দেশনা জরুরি।”
এডিনবরার প্রজনন স্বাস্থ্য গবেষণা কেন্দ্রের প্রফেসর রিচার্ড অ্যান্ডারসন যোগ করেছেন, “নতুন ডিম্বাণু তৈরির ক্ষমতা বিশাল অগ্রগতি হবে, তবে নিরাপত্তা নিয়ে বড় উদ্বেগ থাকবে। তবু এটি বহু নারীর জন্য নিজের জেনেটিক সন্তান পাওয়ার পথ তৈরি করতে পারে।”
মূল প্রতিবেদন: বিবিসি