নবীজির প্রতি প্রথম ওহি নাজিলের ঘটনা
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৯:৪১, ৯ অক্টোবর ২০২৫

হেরা গুহা, এখানেই নবীজির প্রতি প্রথম ওহি নাজিল হয়
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ওপর সর্বপ্রথম ওহি নাজিল হয় ৪০ বছর বয়সে। ওহি নাজিলের আগে পৃথিবী ছিল কুসংস্কার, অবিচার ও অন্ধকারে নিমজ্জিত। মানুষ ছিল দিশেহারা এবং সঠিক দিকনির্দেশনা থেকে বঞ্চিত। সেই ঘন অন্ধকার ভেদ করেই নাজিল হয় আল্লাহর বাণী।
মক্কার চারপাশে পাহাড়-পর্বতে ঘেরা নির্জন পরিবেশে হেরা নামের একটি গুহা ছিল নবী করিম (সা.)-এর ধ্যানে মগ্ন হওয়ার জায়গা। তিনি প্রায়ই সেখানে চলে যেতেন। সেখানে তিনি চিন্তা করতেন আল্লাহর মহত্ত্ব নিয়ে, মানবতার মুক্তি নিয়ে। এই একান্ত সাধনা চলাকালে এক রাতে আসমান থেকে নেমে আসেন ফেরেশতা জিবরাইল (আ.)।
রমজান মাসের এক রাতে তিনি হেরা গুহায় ধ্যানরত অবস্থায় ছিলেন। হঠাৎ জিবরাইল (আ.) এসে নবীজিকে জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘ইকরা’ তথা পড়ুন। নবীজি (সা.) ভয়ে কেঁপে উঠলেন, উত্তর দিলেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না।’ এভাবে তিনবার কথোপকথনের পর জিবরাইল (আ.) নবীজি (সা.)-কে বুকে জড়িয়ে চাপ দিয়ে বললেন, ‘পড়ুন আপনার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন। তিনি মানুষকে সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্তপিণ্ড থেকে। পড়ুন, আপনার প্রতিপালক মেহেরবান। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন, মানুষকে শিখিয়েছেন যা সে জানত না।’ (সুরা আলাক ১-৫)
এখান থেকে ৬টি শিক্ষা ও নির্দেশনা পাওয়া যায়। তা হলো- এক. মুহাম্মাদ (সা.) আল্লাহর নবী ও রাসুল। তার ওপর নাজিল হয়েছে আল্লাহর চূড়ান্ত ও সর্বশ্রেষ্ঠ কিতাব আল কোরআন। দুই. পড়া শুরু করতে হবে আল্লাহর নামে, ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ অর্থাৎ ‘পরম করুণাময় ও দয়াময় আল্লাহর নামে শুরু করছি’ বলে। তিন. মাতৃগর্ভে শুক্রকীট জমাট রক্তে পরিণত হয়। এরপর বিভিন্ন ধাপ পার হয়ে মানুষের শরীর পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করে। চার. আল্লাহ মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ করুণার আধার। আল্লাহর চেয়ে বেশি দয়া ও করুণা কারো নেই। পাঁচ. লেখার বিশেষ গুরুত্ব ও মর্যাদা রয়েছে। লেখার মাধ্যমেই জ্ঞান সংরক্ষিত হয় এবং এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মের কাছে পৌঁছে যায়। ছয়. জীবজগতে মানুষের ওপর আল্লাহ বিশেষ অনুগ্রহ করেছেন তাকে জ্ঞান দান করে, লিখতে ও জ্ঞান সংরক্ষণ করতে শিখিয়ে।
প্রথম ওহি নাজিলের পর নবী করিম (সা.) ভয়ে ও শিহরণে কাঁপতে কাঁপতে বাড়ি ফিরে আসেন। স্ত্রী খাদিজা (রা.)-কে বলেন, ‘আমাকে কম্বল দ্বারা আবৃত করো, আমাকে কম্বল দ্বারা আবৃত করো।’ নবীজি (সা.) নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কিত হলেন। খাদিজা (রা.) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘আল্লাহ কখনো আপনাকে হতাশ করবেন না। আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, গরিবদের সাহায্য করেন, অতিথি আপ্যায়ন করেন এবং অসহায়দের পাশে থাকেন।’
খাদিজা (রা.) নবীজিকে নিয়ে যান তার চাচাতো ভাই ওয়ারাকা ইবনে নওফলের কাছে। ওয়ারাকা ছিলেন একজন খ্রিস্টান পণ্ডিত, যিনি পূর্বের আসমানি কিতাবগুলো নিয়ে গবেষণা করতেন। তিনি নবীজির অভিজ্ঞতা শুনে বললেন, ‘এ সেই মহান ফেরেশতা জিবরাইল, যিনি মুসা (আ.)-এর কাছে আসতেন। হায়, আমি যদি তখন জীবিত থাকতাম, যখন আপনার কওম আপনাকে বের করে দেবে।’ নবীজি (সা.) অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তারা কি আমাকে বের করে দেবে?’ ওয়ারাকা উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, যেই আল্লাহর বার্তা নিয়ে আসে, তার সঙ্গেই এমন ঘটে।’ (সহিহ বুখারি)
এইভাবেই শুরু হয় নবুওয়তের যাত্রা। প্রথম ওহি নাজিলের মাধ্যমে পৃথিবীতে সত্য, জ্ঞান ও ন্যায়ের আলো জ্বলে ওঠে। সেই আলো আজও বিশ্ব মানবতার দিশারি।
প্রথম ওহি শুধু ইসলামের নয়, সমগ্র মানবতার মুক্তির সূচনা। এটি প্রমাণ করে ইসলাম মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও জ্ঞানের বিকাশ চায়। মানুষকে সে আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত করতে চায়। তাই প্রথম বাণী ছিল ‘পড়ুন’, যা যুগে যুগে মুসলিম উম্মাহকে জ্ঞানচর্চার পথে আহ্বান করে আসছে।