কোরআন সংকলনের ইতিহাস
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১০:০১, ৭ অক্টোবর ২০২৫

কোরআন মুসলমানদের জীবনের দিশারী। আল্লাহতায়ালা তা নাজিল করেছেন মানুষের পথপ্রদর্শনের জন্য। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে জিবরাইল আলাইহিস সালাম ধাপে ধাপে, বিভিন্ন সময়ে, নানা প্রেক্ষাপটে এই ওহি পৌঁছে দেন। হিজরতের পূর্বে মক্কার তেরো বছর এবং মদিনার দশ বছরে অবতীর্ণ হয় পূর্ণ কোরআন। সাহাবায়ে কেরামরা তা হৃদয়ে ধারণ করতেন, মুখস্থ করতেন এবং নামাজে পাঠ করতেন। অনেকে লিখেও রাখতেন খেজুরপাতা, হাড়ের টুকরো, চামড়া কিংবা পাথরে খুদাই করে। কিন্তু পূর্ণাঙ্গভাবে সংকলিত কিতাব আকারে তখনো সাজানো হয়নি।
রাসুলুল্লাহ (সা.) জীবিত থাকাকালে কোরআনের সংরক্ষণ ছিল মুখস্থ ও আংশিক লিখিত অবস্থায়। প্রতিটি আয়াত নাজিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি সাহাবিদের মুখস্থ করিয়ে দিতেন এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত লেখকদের নির্দেশ দিতেন তা লিখে রাখতে। কোরআনের আয়াতগুলো কোথায় স্থাপন করতে হবে, কোন সুরার সাথে যুক্ত করতে হবে তাও তিনি বলে দিতেন। এভাবেই কোরআনের সংরক্ষণ নিশ্চিত হয়, তবে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থরূপ তখনো তৈরি হয়নি।
নবীজির ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মাহর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ দেখা দেয়। ইয়ামামার যুদ্ধে বহু হাফেজে কোরআন সাহাবি শহীদ হন। এতে আশঙ্কা দেখা দেয় যে, যদি এভাবে আরও হাফেজ শহীদ হতে থাকেন, তবে কোরআনের কিছু অংশ হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হতে পারে। এ প্রেক্ষাপটে হজরত ওমর ইবনে খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু প্রস্তাব দেন কোরআনকে একত্রে সংকলনের জন্য। প্রথমে খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহু দ্বিধাগ্রস্ত হন। তিনি মনে করলেন, যেহেতু রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআনকে একত্রে গ্রন্থ আকারে সংকলন করেননি, তাই তার উদ্যোগ নেওয়াটা হয়তো ঠিক হবে না। কিন্তু হজরত ওমরের যুক্তি তাকে সন্তুষ্ট করল। অবশেষে তিনি সাহাবিদের মতামত নিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোরআন একত্রে সংকলন করা জরুরি।
এই কাজের জন্য নিয়োগ দেওয়া হলো নবীজির সাহাবী ও বিশিষ্ট কারি জায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহুকে। কারণ তিনি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর ওহি লিখিয়েদের অন্যতম ছিলেন, অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ও প্রজ্ঞার অধিকারী ছিলেন। তাকে দায়িত্ব দিয়ে বলা হলো, কোরআনের প্রতিটি আয়াত দুই সাক্ষীর প্রমাণ ছাড়া লিখবেন না। অর্থাৎ যেসব সাহাবি মুখস্থ করেছিলেন, তাদের বয়ান এবং লিখিত দলিল উভয় দিক থেকে যাচাই করতে হবে।
জায়েদ ইবনে সাবেত রাদিয়াল্লাহু আনহু কাজ শুরু করলেন। প্রতিটি আয়াত যাচাই করে, সাহাবিদের মুখস্থের সাথে মিলিয়ে, লিখিত নথির সাথে মিলিয়ে তিনি সংগ্রহ করলেন। এভাবে একত্রে সংকলিত হলো পূর্ণ কোরআন শরীফ। এটি তখন খলিফা আবু বকরের কাছে রাখা হলো। তার মৃত্যুর পর হজরত ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর নিকট সংরক্ষিত থাকে। তার ইন্তেকালের পর তা তার কন্যা হাফসা রাদিয়াল্লাহু আনহার কাছে থাকে। তিনি ছিলেন রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্ত্রী এবং কোরআনের নির্ভরযোগ্য হাফেজা।
পরবর্তীতে হজরত ওসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর খেলাফতের সময় আবার একটি নতুন পরিস্থিতি দেখা দেয়। ইসলামের বিস্তৃতি ঘটল, দূরদূরান্তে মানুষ ইসলাম গ্রহণ করল। তারা নানা অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করল। ফলে উচ্চারণ ও কেরাতের ভিন্নতা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেয়। অতঃপর বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত উচ্চারণভেদ, পাঠভেদ বা লিখিত ভিন্নতা দূর করে একটি নির্দিষ্ট পাঠরীতি এবং লিখনশৈলীকে সরকারিভাবে নির্ধারণ করা হয়। এরপর কয়েকটি অনুলিপি তৈরি করে বিভিন্ন প্রদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। অন্যসব অনুলিপি ধ্বংসের নির্দেশ দেওয়া হয়, যেন কোথাও বিভ্রান্তি না থাকে। ফলে পুরো মুসলিম উম্মাহ একই লিখিত ও পাঠরীতি অনুসারে কোরআন পাঠ করতে থাকে।
এভাবেই প্রথমে আবু বকর সিদ্দিক রাদিয়াল্লাহু আনহুর আমলে কোরআন একত্রে সংকলিত হয়। আর ওসমান ইবনে আফফান রাদিয়াল্লাহু আনহুর সময়ে তা একক মানক রূপ পায় এবং আজ পর্যন্ত অক্ষুণ্ণভাবে সংরক্ষিত আছে। কোরআনের সংকলনের বিষয়টি ইসলামের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল অধ্যায়। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে, আল্লাহতায়ালা যেমন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘নিশ্চয়ই আমিই কোরআন নাজিল করেছি এবং আমি নিজেই তা সংরক্ষণ করব।’ (সুরা হিজর ৯) সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্যই সাহাবায়ে কেরামের এই মহৎ প্রয়াস ছিল আল্লাহর কুদরতেরই অংশ।
কোরআন আজও অক্ষত, অবিকৃত ও বিশুদ্ধ। পৃথিবীর কোনো গ্রন্থ এমনভাবে সংরক্ষিত হয়নি। এ কারণে কোরআনের প্রথম সংকলন শুধু একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং মুসলিম উম্মাহর জন্য এক অনন্য আশীর্বাদ, যা আল্লাহর প্রতিশ্রুতিরই বাস্তব রূপ।