আইসিডিডিআর,বির গবেষণা
ফাঙ্গাল সুপারবাগে আক্রান্ত ৫৬% নবজাতক ও মারা যাচ্ছে ২২%
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৬:৩৩, ৯ নভেম্বর ২০২৫
দেশের হাসপাতালের নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা এনআইসিইউ’তে প্রাণঘাতী ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ বা ‘ফাঙ্গাল সুপারবাগ’ ছত্রাকের সংক্রমন নিয়মিত ঘটছে। এনআইসিইউতে ভর্তির পর অর্ধেকের বেশি নবজাতক এই ছত্রাকে সংক্রমিত হচ্ছে।
আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। রবিবার (৯ নভেম্বর) প্রতিষ্ঠানটি গবেষণার এই ফল প্রকাশ করে।
গবেষণাটি বলছে, দেশের হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তির পর ৫৬ শতাংশ নবজাতক ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ বা ‘ফাঙ্গাল সুপারবাগ’ ছত্রাকে আক্রান্ত হচ্ছে ও মারা যাচ্ছে ২২ শতাংশ নবজাতক।
এমনকি এসব এনআইসিইউতে থাকা অনেক নবজাতক এই ছত্রাকের সংক্রমনের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে।
২০২১ সালের আগস্ট থেকে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকার একটি সরকারি ও একটি বেসরকারি হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি নবজাতকদের মধ্যে আইসিডিডিআর,বি এই গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষণা প্রসঙ্গে আইসিডিডিআর,বির সহযোগী বিজ্ঞানী ও সংক্রামক রোগ বিভাগের এএমআর রিসার্চ ইউনিটের প্রধান ডা. ফাহমিদা চৌধুরী বলেন, “এই গবেষণা নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে গুরুতর অসুস্থ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাচ্চাদের মধ্যে এই ‘সুপারবাগ’ এর সংক্রমণের গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ দিয়েছে। এটি প্রশাসনিকভাবে ও পলিসি লেভেলে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রথম ধাপ।”
গবেষকরা এনআইসিইউতে ভর্তি হওয়ার সময় এবং পরবর্তী সময়ে নবজাতকদের ত্বকে বা রক্তে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণ বা অবস্থানের (কলোনাইজেশন) জন্য পরীক্ষা করেন, যাতে হাসপাতালের ভেতরে সংক্রমণ ছড়ানোর ধরণ বোঝা যায়।
আইসিডিডিআর,বি দেশের দুটি টারশিয়ারি লেভেল হাসপাতালে এই গবেষণা করে। গবেষণায় সহযোগিতা করেছে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ও অর্থায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
‘ফাঙ্গাল সুপারবাগ’ কি
আইসিডিডিআর,বি জানায়, ক্যান্ডিডা অরিস এমন এক ধরনের ছত্রাক যা মানুষের ত্বকে কোনো লক্ষণ প্রকাশ করা ছাড়াই অবস্থান করতে পারে এবং দীর্ঘ সময় টিকে থাকতে পারে। প্রায় ১০ শতাংশ ক্ষেত্রে এই অবস্থান থেকে সংক্রমণে পরিণত হয়। সাধারণত রক্তের মতো জীবাণুমুক্ত অংশের মাধ্যমে এটি অনুপ্রবেশ করে, যা রোগটিকে অনেক বেশি প্রাণঘাতী করে তোলে।
অনুন্নত ও স্বল্পোন্নত দেশে ক্যান্ডিডা অরিস-জনিত রোগে হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের মৃত্যুর হার প্রায় ৭০ শতাংশ লক্ষ্য করা গেছে। দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন, গুরুতর অসুস্থ রোগী এবং অপরিণত নবজাতকদের মধ্যে এটি বিশেষভাবে বিপজ্জনক। ফলে এনআইসিইউতে থাকা অনেক নবজাতক উচ্চ ঝুঁকিতে থাকে।
এই ছত্রাকটি প্রায়শই একাধিক অ্যান্টিফাঙ্গাল ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী। এ কারণে সিডিসি একে ২০১৯ সালে “অতি জরুরি অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হুমকি” হিসেবে ঘোষণা করেছে।
আইসিডিডিআর,বি আরও জানায়, দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ব্যবহৃত বিভিন্ন যন্ত্রপাতিতে টিকে থাকা, দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এবং উচ্চ মাত্রার অসুস্থতা ও মৃত্যুর ক্ষমতাসম্পন্ন হওয়ায় ক্যান্ডিডা অরিসকে “হাসপাতাল-সম্পর্কিত সুপারবাগ” হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
কি পেল গবেষণা
গবেষণার তথ্য অনুযায়ি, ফাঙ্গাল সুপারবাগে আক্রান্ত ৩৭৪ জন নবজাতকের মধ্যে ৩২ জন (৯%) রোগী ত্বকে ক্যান্ডিডা অরিস বহন করছিল এবং একজন বা শূণ্য দশমিক ৩ শতাংশ রোগীর রক্তে সংক্রমণ ধরা পড়ে।
এই ৩২ জনের মধ্যে ১৪ জন (৪৪%) ভর্তি হওয়ার সময়ই আক্রান্ত ছিল এবং ১৮ জন (৫৬%) ভর্তি হওয়ার পর সংক্রমিত হয়।
ভর্তি হওয়ার সময় আক্রান্ত ১৪ জনের মধ্যে ১৩ জন অন্য হাসপাতাল বা ওয়ার্ড (যেমন প্রসূতি ওয়ার্ড) থেকে স্থানান্তরিত হয়েছিল, কেবল একজন এসেছিল বাড়ি থেকে।
সংক্রমিত ৩২ জনের মধ্যে ৭ জন (২২%) মারা যায়, যার মধ্যে রক্ত সংক্রমিত বাচ্চাটিও ছিল।
হাসপাতালের পরিবেশেই টিকে থাকে
আইসিডিডিআর,বি জানায়, গবেষণার এই ফলাফল আইসিডিডিআর,বির আরেকটি সাম্প্রতিক গবেষণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যেখানে নতুনভাবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া কোনো রোগীর মধ্যেই লোকালয় থেকে ক্যান্ডিডা অরিস পাওয়া যায়নি।
এতে আরও জোরালোভাবে প্রমাণিত হয় যে, এই ছত্রাকটি হাসপাতালের পরিবেশেই টিকে থাকে এবং সেখান থেকেই ছড়ায়।
কোন ওষুধ কার্যকর
গবেষণায় বলা হয়, বর্তমান গবেষণায় ক্যান্ডিডা অরিস এর মাত্র ৩টি (৯%) আইসোলেট একাধিক ওষুধের প্রতি প্রতিরোধী ছিল, তবে ৮২ শতাংশ ছিল ফ্লুকোনাজোল প্রতিরোধী, যা রক্তে ছত্রাকজনিত সংক্রমণের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত প্রথম সারির ওষুধ।
আক্রান্তের ৮১% সিজারিয়ান নবজাতক
গবেষণার তথ্য অনুযায়ি, যেসকল রোগীদের মধ্যে ক্যান্ডিডার উপস্থিতি পাওয়া গেছে, তাদের ৮১ শতাংশের জন্ম সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে হয়েছিল।
গবেষকরা ধারণা করছেন, সিজারিয়ান ডেলিভারির পর দীর্ঘ সময় হাসপাতালে অবস্থান করার ফলে ক্যান্ডিডা অরিস-এর সংস্পর্শে আসার সুযোগ বেড়ে যায়।
গবেষকদের পরামর্শ
গবেষকরা এনআইসিইউ এবং অন্যান্য হাসপাতাল পরিবেশে এই ছত্রাকের টিকে থাকা ও ছড়ানো রোধে কার্যকরী ক্লোরিন-ভিত্তিক জীবাণুনাশক দিয়ে নিয়মিত হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র পরিষ্কার করা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের হাত ধোয়ার অভ্যাস উন্নত করার সুপারিশ করেছেন।
তারা আরও বলেন, এনআইসিইউতে ক্যান্ডিডা অরিস সংক্রমণের ধারাবাহিক নজরদারি চালিয়ে যাওয়া অত্যন্ত জরুরি, যাতে আক্রান্ত হওয়া নবজাতকদের শনাক্ত করে দ্রুত আলাদা রাখা যায়, ছড়িয়ে পড়া রোধ করা যায় এবং দ্রুত অ্যান্টিফাঙ্গাল চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয়।
অন্যান্য দেশেও এই ছত্রাক
আইসিডিডিআর,বি জানায়, হাসপাতাল সম্পর্কিত সংক্রমণ (এইচএআই) জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি বড় সমস্যার সৃষ্টি করছে। এসব সংক্রমণের মধ্যে ‘ক্যান্ডিডা অরিস’ বা ‘ফাঙ্গাল সুপারবাগ’ ছত্রাক (ফাঙ্গাস) সম্প্রতি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ক্যান্ডিডা সংক্রমণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
সম্প্রতি মাক্রোবায়োলজি স্পেকট্রাম জার্নালে প্রকাশিত আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যান্ডিডা অরিস বাংলাদেশে নবজাতকদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (এনআইসিইউ) ছড়িয়ে পড়ছে।
