আধ্যাত্মিক প্রেমের অমর কবি
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ১৯:৫৯, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৪৩, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৫

জালালুদ্দিন মুহাম্মদ রুমি বিশ্বের অন্যতম আধ্যাত্মিক কবি, সুফি সাধক ও দার্শনিক। তিনি ১২০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩০ সেপ্টেম্বর বর্তমান আফগানিস্তানের বালখে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বালখের একজন প্রখ্যাত আলেম ও ধর্মীয় শিক্ষক ছিলেন। রুমি ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা ও মঙ্গলদের আক্রমণের কারণে তার পরিবার বালখ ছেড়ে বিভিন্ন শহরে ভ্রমণ করে। শেষে তারা স্থায়ীভাবে আনাতোলিয়ার কনিয়া শহরে বসবাস স্থাপন করেন, যা বর্তমান তুরস্কের অন্তর্গত।
তুরস্কের বুকাতে রুমির ভাস্কর্য
রুমির সাহিত্যিক ও আধ্যাত্মিক প্রতিভার প্রধান নিদর্শন হলো তার রচিত মসনবী শরীফ। এটি প্রায় ৪০ হাজার শেরের সমন্বয়ে রচিত এবং ফার্সি ভাষায় লেখা। রুমি নিজ গ্রন্থকে কেবল কবিতা হিসেবে নয়, বরং এটিকে ইসলামের নৈতিক শিক্ষা, আধ্যাত্মিক জ্ঞান এবং কোরআনের শিক্ষার প্রতিফলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মসনবী শরীফ মানুষের অন্তরের পরিশোধন, আল্লাহর প্রেম এবং মানব জীবনের আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ দেখায়।
মসনবীর প্রথম পৃষ্ঠায় রুমি লিখেছেন, ‘হাযা কিতাবুল মসনবী, ওয়া হুওয়া উসুলু উসুলি উসুলিদ-দ্বীন, ওয়া কাশুশাফুল কোরআন’। অর্থাৎ ‘এই হচ্ছে মসনবী শরীফ। এটি (ইসলাম) ধর্মের মূলের মূলের মূল এবং এটি কোরআনের বর্ণনাকারী।’ এটা থেকে বোঝা যায়, রুমি মসনবীকে ইসলামের শিক্ষা, নৈতিকতা এবং কোরআনের বাণীর আধ্যাত্মিক প্রতিফলন হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। মসনবী শরীফ থেকে বিশেষ কয়েকটি লাইন উল্লেখ করা হলো।
মসনবী শরীফ
এক. ‘এশকে আমদ ও শুদ জান হামাহ রাজ আশকার/ জাজ আজ মহর ও মহাব্বত নাশদ হিচ কার।’ অর্থাৎ ‘ভালোবাসা এলো এবং সব রহস্য প্রকাশ হলো/ কেবল প্রেম ও স্নেহের মাধ্যমেই সবকিছু সম্ভব।’ এখানে রুমি প্রেমকে জীবনের মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করেছেন। প্রেমের মাধ্যমেই সব কিছু সম্ভব। আর আল্লাহর প্রেম ছাড়া জীবন ও আত্মার প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করা যায় না।
দুই. ‘হার কিছি কেহ খোদ রা শনাখত, খোদা রা শনাখত’। অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি নিজেকে চেনে, সে আল্লাহকে চেনে।’ রুমি এখানে আত্মজ্ঞানকে আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও আল্লাহর নৈকট্যের মূল হিসেবে দেখিয়েছেন।
তিন. ‘চশমে দিল রা বাজ কুন, তা হকিকত রা বেবিনি’। অর্থাৎ ‘হৃদয়ের চোখ খুলো, যাতে তুমি সত্য দেখতে পাও।’ রুমি এখানে অন্তরের দৃষ্টি খোলার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। হৃদয়ের মাধ্যমে সত্য উপলব্ধি করা সম্ভব।
চার. ‘হার কিছি বা এশকে জিন্দেগি কুনাদ/ বা খোদা জিন্দেগি মি কুনাদ’। অর্থাৎ ‘যে ব্যক্তি প্রেমে জীবন কাটায়, সে আল্লাহর সঙ্গে জীবন কাটায়।’ রুমি বুঝাচ্ছেন, প্রেমই জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য। প্রেমের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করা যায়।
পাঁচ. ‘হার কেহ দার এশকে গরক শুদ, আজ হামে চিজ ফারেগ শুদ’। অর্থাৎ ‘যে প্রেমে নিমগ্ন হয়, সে দুনিয়ার সব ব্যাপার থেকে মুক্তি পায়।’ রুমি এখানে বলছেন, প্রেমই মানুষের প্রকৃত মুক্তির পথ। প্রেমের মাধ্যমে সব কিছু থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
উসমানীয় যুগের একটি পুঁথি, যেখানে রুমি ও শামস তাবরিজী সম্পর্কে চিত্রিত করা হয়েছে
রুমি আমেরিকায় প্রচণ্ড জনপ্রিয়। তার আধ্যাত্মিকতা, অন্তর্দৃষ্টি ও মানবিকতার প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি পশ্চিমা পাঠক ও সমাজের নানা স্তরে বিস্তৃত অনুপ্রেরণা দিয়েছে। রুমি মূলত প্রেম, আত্মজ্ঞান, নৈতিকতা ও আধ্যাত্মিক যাত্রাকে কেন্দ্র করে লিখেছেন। এই বিষয়গুলো পশ্চিমা সমাজের মানুষদের কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। কারণ আধুনিক জীবনের তাড়াহুড়ো ও মানসিক চাপের মাঝে তারা শান্তি ও অন্তর্দৃষ্টি খুঁজে পেতে চান। কেননা রুমি সবসময় হৃদয়কে চাঙা করতে চেয়েছেন, হৃদয়ের শক্তি প্রদর্শনে উৎসাহিত করেছেন। তাই তো তিনি বলেছেন, কেবল হৃদয় দিয়েই আকশ ছোঁয়া যায়!
রুমির কবিতা ও দর্শনের ইংরেজি অনুবাদ বহুবার প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে কোলম্যান বার্কসের অনুবাদ রুমিকে ব্যাপকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। আমেরিকায় মসনবী শরীফ এবং অন্যান্য রচনার সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি অনেকেই পড়ে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করে। বইয়ের দোকান, পাবলিক লাইব্রেরি এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্মে রুমির বইয়ের চাহিদা অনেক। শুধু সাহিত্যপ্রেমী নয়, আধ্যাত্মিক অনুসন্ধানকারী এবং মেডিটেশন পছন্দকারীরাও রুমির বাণী থেকে অনুপ্রেরণা নেন।
রুমির মসনবী শরীফসহ অন্যান্য শেরের জনপ্রিয় অনুবাদক কোলম্যান বার্কস
আমেরিকায় রুমির জনপ্রিয়তার একটি বড় কারণ হলো, তার কবিতার সারল্য ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। রুমি কখনো সরাসরি ধর্মীয় গণ্ডি নির্ধারণ করেননি, বরং আধ্যাত্মিক প্রেম, আত্মপরিচয় এবং সৃষ্টির সঙ্গে মিলনের শিক্ষা দিয়েছেন। এই সারল্য পশ্চিমা পাঠকদের কাছে দারুণভাবে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তার শেরগুলোতে বারবার ‘প্রেম’, ‘আত্মজ্ঞান’, ‘মানবতা’ ও ‘আধ্যাত্মিক যাত্রা’-এর মতো বিষয়গুলো প্রাধান্য পেয়েছে, যা আধুনিক জীবনের মানসিক চাপ ও বিচ্ছিন্নতার মধ্যে শান্তি খুঁজতে সাহায্য করে।
আমেরিকার সেলিব্রিটি ও শিক্ষাবিদরাও রুমিকে সমাদর করেন। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাহিত্য ও ধর্মতত্ত্ব বিভাগে রুমি নিয়ে গবেষণা এবং সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সামাজিক মাধ্যমে রুমির বাণী ও ছবি-উদ্ধৃতি প্রচুর শেয়ার করা হয়।
রুমি ছিলেন আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তার দর্শন ও শিক্ষা আজও কোটি মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে। মানুষের অন্তরের পরিশোধন, প্রেম ও আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য রুমি যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, তা যুগে যুগে প্রাসঙ্গিক। তার কবিতা ও সুফি দর্শন আধ্যাত্মিক, নৈতিক ও মানবিক জ্ঞানের এক অনন্য ভাণ্ডার।