ইমরুল সুমন
ইতিহাস গড়া নারী ফুটবলারদের নাম বলতে, নাম লিখতে এতো কার্পন্য আপনাদের
প্রকাশ: ১০:১৫, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ | আপডেট: ১৮:০৯, ২২ আগস্ট ২০২৫

অনেক দিন পর পত্রিকার স্পোর্টসের পাতা সবাই সময় নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখলেন, পড়লেন। আফসোস! বেশীরভাগ নামকরা দৈনিক পত্রিকাতেই দক্ষিণ এশিয়া জয় করা বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের নামের তালিকাটাই নেই। ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি. স্বাগতিক নেপালকে ফাইনালে ৩-১ গোলে হারিয়ে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে বাংলাদেশ। যে দল সাফল্য এনে দিলো, ইতিহাস গড়লো, সবাই যাদের দেশের হিরো বলছেন- তাদের ছোট্ট নামগুলো লিখতে কেন কার্পন্য করছেন নেপাল সফররত এদেশের নামকরা ক্রীড়া সাংবাদিক ও স্পোর্টস রিপোর্টাররা। আর দেশে থাকা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, টেলিভিশন বা অনলাইন নিউজ পোর্টালের স্পোর্টস এডিটর, নিউজ এডিটর, হেড অব নিউজ, এডিটর ইন চিফ, বার্তা সম্পাদক, শিফট ইন চার্জ বা সম্পাদকরাই কেন ইতিহাস গড়া এই দলটির খেলোয়াড়দের নামগুলো উচ্চারণ করতে, প্রকাশ করতে, ছাপতে কার্পন্য করছেন। শুধু কি একজন স্ট্রাইকার দলকে জেতান? না কি একজন গোলকিপার দলের জয় এনে দেন। না কি একজন কোচের কথাতেই ট্রফি চলে এসেছে ঘরে। আজ যে মেয়েগুলো বছরের পর বছর রক্তকে ঘাম বানিয়ে, নিজেদের রোদে পুড়িয়ে, নারীদেহের সৌন্দর্যকে দেশের জন্য উৎসর্গ করে সাফল্য ছিনিয়ে এনেছে তাদের পরিবার তাদের আত্মীয়-স্বজন-প্রিয়জন কি ইতিহাস গড়ার এই দিনে আজ পত্রিকার পাতায় টেলিভিশনে তাদের সন্তানদের নাম ও ছবিটা দেখতে প্রত্যাশা করতে পারেন না। পত্র-পত্রিকায় খেলার রিপোর্টে খেলোয়াড়দের তালিকাটি দেয়া রিপোর্টেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। অথচ আমাদের দেশের 'ক্রিকেট বায়াস' রিপোর্টার/এডিটররা শুধু ক্রিকেট ম্যাচে খেলোয়াড়দের নামের তালিকাটি পত্র-পত্রিকায় ছাপছেন, রেডিও টিভিতে প্রচার করছেন, গণমাধ্যমে প্রকাশ করছেন। ফুটবল, হকি, ভলিবল, বাস্কেটবল, হ্যান্ডবল, বেসবল, রাগবি'র মতো দলীয় খেলাগুলোতে পেইজ বা পাতার অংশ বাঁচানোর কথা বলে খেলোয়াড়দের নামগুলো ছেটে দিচ্ছেন অনায়াসেই। মনে হচ্ছে দেশে খেলা একটাই-সেটা ক্রিকেট। স্পোর্টসের পাতার সিংহভাগ অংশ জুড়েই কেবল ক্রিকেট বিষয়ক লেখা ছাপা হচ্ছে। আজ ইতিহাস গড়ার এই দিনে সাফল্য এনে দেয়া নারী দলের খেলোয়াড়দের নামগুলো ছেটে দিয়ে প্রথম আলো, সমকাল, জনকন্ঠ, কালের কন্ঠ, যুগান্তর, মানবজমিনের মতো দেশসেরা পত্রিকাগুলো গর্হিত কাজ করেছে। দৈনিক ইত্তেফাকের বন্ধুবর স্পোর্টস এডিটর সোহেল সারোয়ার চঞ্চল মেয়েদের দক্ষিন এশিয়া জয়ের খেলার নিউজটির ভেতরে নারী ফুটবলারদের ছোট নামগুলো অল্প আকারে হলেও ছেপেছেন। দৈনিক ইনকিলাবের সিনিয়র স্পোর্টস রিপোর্টার জাহেদ খোকন, দৈনিক নয়াদেশ পত্রিকার সম্পাদক বন্ধুবর আলম কিরণ নারী ফুটবলারদের পুরো নাম ছেপেছেন। এজন্য তাদের ধন্যবাদ জানাই। মনে আছে আইসিসি ট্রফি জয়ের দিন আমরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের সবার নাম সন্মানের সাথেই ছেপেছিলাম। পরের দিন ফ্রন্ট পেজ, ব্যাক পেজ, খেলার পেজে ক্রিকেটারদের জয়ের নিউজটি গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়। ক্রিকেটারদের লম্বা গ্রুপ ছবি দিয়ে স্পোর্টসের পাতা'র ওপরের অংশের লোগো সম্বলিত 'মাস্ট হেড' পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলেছিলাম। সেসময় দৈনিক বাংলা মোড়ের পাশে ফকিরেরপুল থেকে প্রকাশিত একটি জাতীয় দৈনিকে আমি স্পোর্টস রিপোর্টার হিসাবে চাকুরী করতাম। নারী ফুটবলাররা আজ যে অসাধ্য সাধন করেছে সেটা ক্রিকেটারদের সেই অবদানের চেয়ে কোন অংশে কম নয়। সবগুলো পত্রপত্রিকা ও মিডিয়ায় লিড নিউজ হয়েছে নারী ফুটবলারদের দক্ষিন এশিয়া জয়। খেলার পাতায় বেশিরভাগ অংশ জুড়েই নারী ফুটবলারদের নিউজ। দেশের মৃতপ্রায় ফুটবল ফেডারেশন ও অর্ধমৃত ফুটবলের বাগানে নতুন করে ফুল ফুটানো শুরু করলো এই সাফল্য। দেশের নামকরা মিডিয়াগুলো নারী ফুটবলারদের যথাযথ মূল্যায়ন না করে চরম অন্যায় করেছে। আর সাফ এর সভাপতি হিসেবে ফাইনালে হাজির না থেকে বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন নিকৃষ্টতম বোকামির উদাহরণ রেখে গেলেন এবার। এজন্য আজ নারী ফুটবলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়া ধর্মব্যবসায়ী মৌলবাদীদের সাথে সাথে এই সমস্ত কান্ডজ্ঞানহীন মিডিয়ার কথিত(!) দায়িত্বশীল ও বাফুফের ব্যর্থ কর্মকর্তাদের প্রকাশ্যে ক্ষমা চাওয়া উচিত। সবার মনে রাখা উচিত বাংলাদেশের নারী ফুটবলারদের ইতিহাস সৃষ্টিকারী দিন ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি. কিংবা পত্রিকায় নিউজ ছাপানোর জন্য উপযুক্ত পরের দিন ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ খ্রি. দিনগুলো ক্যালেন্ডারে একবারই এসেছিল। এই হতাভাগা মেয়েগুলো ও তাদের পরিবারের আবেগ অনুভূতি হয়তো নাড়া দেয়নি ক্রীড়া সাংবাদিকদের। হয়তো রিপোর্টাররা এখনো বুঝতে পারেননি এক যুগ ধরে কিভাবে মেয়েগুলো বাফুফে ভবনকে বাসা বানিয়ে দিনের পর দিন অধ্যাবসায় করে গেছেন। সাধনা করেছেন। কিভাবে সমাজের কটাক্ষ শুনে সবুক ঘাসে খেলতে নেমেছিল। কিভাবে জীবন বাজি রেখে মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ফুটবল খেলা চালিয়ে গিয়েছিল। আসুন আজ দেশের আনন্দের দিনে প্রতিটি মেয়ের ছবি ও নাম দিয়ে আলাদা আলাদা স্টোরি প্রকাশ করি। দেশে ফেরা নারীদলকে হুডখোলা দোতলা বাসে চড়িয়ে উৎসবে মেতে উঠি সারাদেশ। ডানা ও গোথিয়া কাপ জয়ী বিকেএসপি কিশোর ফুটবল দল বা আইসিসি ট্রফিজয়ী বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে যেভাবে সারাদেশের মানুষ সম্বর্ধনা দিয়েছে সেভাবে নারী ফুটবলারদের সন্মান ও সম্বর্ধনা দিতে সবাই প্রস্তুত হন। প্রধানমন্ত্রী, ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে আবেদন নারী ফুটবলারদের প্রকৃত সন্মান দিয়ে আমাদের মান সন্মান রক্ষা করুন। সবার জ্ঞাতার্থে দক্ষিণ এশিয়া জয় করে ইতিহাস গড়া বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের খেলোয়াড়দের নামের তালিকাটি নিচে তুলে ধরছি- বাংলাদেশ দল নিয়মিত খেলোয়াড় : ১। গোলরক্ষক রূপনা চাকমা (জার্সি নং ১) ২। শিউলী আজিম (জার্সি নং ২) ৩। শামসুন্নাহার (জার্সি নং ৩) ৪। আঁখি খাতুন (জার্সি নং ৪) ৫। মাসুরা পারভীন (জার্সি নং ৫) ৬। মনিকা চাকমা (জার্সি নং ৬) ৭। সানজিদা আখতার (জার্সি ৭) ৮। মারিয়া মান্দা (জার্সি নং ৮) ৯। কৃষ্ণা রাণী সরকার (জার্সি নং ৯) ১০। সিরাত জাহান স্বপ্না (জার্সি নং ১০) ১১। সাবিনা খাতুন (জার্সি নং ১১) লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক