বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

বেলেন ফার্নান্দেজ

আলাস্কা সম্মেলন ছিল চমকপ্রদ প্রহসন

প্রকাশ: ২০:২৯, ১৭ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৮:০৭, ২২ আগস্ট ২০২৫

আলাস্কা সম্মেলন ছিল চমকপ্রদ প্রহসন

মনে করুন, আপনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এবং আপনার রাজনৈতিক ঘাঁটির এক বিরাট অংশের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক আর আগের মতো সৌহার্দ্যপূর্ণ নেই। তখন কী করবেন?

একটি উপায় হলো, এক জাঁকজমকপূর্ণ সম্মেলনের আয়োজন করা, যেখানে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বসে দৃশ্যত ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধানের চেষ্টা করা হবে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প সম্প্রতি ঠিক এ কাজটিই করেছেন। শুক্রবার তিনি আলাস্কায় রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে লালগালিচা সংবর্ধনা দেন। বহুল প্রত্যাশিত এই বৈঠক শেষ পর্যন্ত নিস্ফল হয়। আর ট্রাম্প শুধু বলেন, ‘চুক্তি না হওয়া পর্যন্ত কোনো চুক্তি নেই।’

ফক্স নিউজ জানিয়েছে, ট্রাম্প বৈঠকটিকে ‘দশের মধ্যে দশ’ রেটিং দিয়েছেন। তিনি নাকি বিশেষভাবে খুশি হয়েছেন পুতিনের মন্তব্যে, যেখানে রুশ প্রেসিডেন্ট দাবি করেন, ২০২০ সালে ট্রাম্প জিতলে ইউক্রেনে আগ্রাসন হতো না। তবে এ মন্তব্যের পেছনে যুক্তি ব্যাখ্যা করার বিষেয়টি দুজনেই এড়িয়ে যান।

যাই হোক, ফলহীন এই বৈঠক ট্রাম্পের জন্য কাজে দিয়েছে এক রাজনৈতিক ‘বিভ্রান্তি’ হিসেবে। কারণ তার নিজের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ ঘাঁটির ভেতরে অশান্তি বেড়ে চলেছে। এর একটি কারণ হলো, জেফ্রি এপস্টিন সংক্রান্ত নথিপত্র। ২০১৯ সালে কারাগারে মৃত্যুবরণ করা এপস্টিন ছিলেন বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব এবং দণ্ডিত যৌন অপরাধী। গত মে মাসে মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল পাম বন্ডি ট্রাম্পকে জানান, বিচার বিভাগ যে তথাকথিত এপস্টিন ফাইল পরীক্ষা করছে, সেখানে তার নামও রয়েছে।

নির্বাচনী প্রচারণায় নথিপত্র প্রকাশের প্রতিশ্রুতি দিলেও ট্রাম্প এ বছর অবস্থান বদলান। তিনি তদন্তকে প্রহসন বলে উড়িয়ে দেন এবং নিজের অনেক রিপাবলিকান সমর্থককে বোকা ও মূর্খ বলে অপমান করেন, কারণ তারা এখনো তা প্রকাশের দাবিতে অনড়। গত ১২ জুলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি রীতিমতো ক্ষোভ ঝেড়ে বলেন, ‘আমাদের দক্ষ প্রশাসন আর কিছু স্বার্থপর লোক মৃত জেফ্রি এপস্টিনকে কেন্দ্র করে পুরো পদ্ধতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইছে।’

কিন্তু এপস্টিন ঝামেলা একমাত্র মাথাব্যথা নয়। ট্রাম্পের সমর্থক ঘাঁটির ভেতর থেকেই এখন সমালোচনা বাড়ছে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যাকে নিয়ে। অক্টোবর মাসে যার দুই বছর পূর্ণ হতে চলেছে। এখন পর্যন্ত সরকারি হিসাবে প্রায় ৬২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যদিও প্রকৃত সংখ্যা নিঃসন্দেহে আরও অনেক বেশি।

দীর্ঘদিন ধরে নির্বিচার হত্যাযজ্ঞ, শিশুদের হত্যা ও বিকলাঙ্গ করা, হাসপাতাল ধ্বংস আর পাড়া-মহল্লা নিশ্চিহ্ন করাও ছিল মার্কিন রাজনৈতিক মহলের কাছে সহনীয়। কিন্তু এখন যখন গণ-অনাহার দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে, তখন অনেক পূর্বতন সমর্থকও সরে যাচ্ছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, কেবল অপুষ্টিতে মৃত্যু হয়েছে ২৫১ জনের, যাদের মধ্যে ১০৮ শিশু। কঙ্কালসার ফিলিস্তিনিদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে ইন্টারনেটে। জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি গাজাকে বিপর্যয়কর খাদ্য সংকটে আক্রান্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করেছে।

এছাড়া জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী শুধু গত মে মাসের শেষ থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনারা ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা কমপক্ষে ১ হাজার ৭৬০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে, এর মধ্যে অনেকেই নিহত হয়েছেন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কথিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রগুলোতে। এই কেন্দ্রগুলো কার্যত সহায়তা বিতরণের আড়ালে গণহত্যার আরেকটি কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

যদিও ট্রাম্প মাঝে মাঝে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে খারাপ চিত্র তৈরি হওয়ার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করেছেন, তবু তা যথেষ্ট হয়নি। রিপাবলিকান কংগ্রেসওমেন মার্জোরি টেইলর গ্রিনের মতো ব্যক্তিত্ব প্রকাশ্যে ট্রাম্পের সমালোচনায় মুখ খুলেছেন। তিনি এক পোস্টে স্পষ্টভাবে লিখেছেন, ‘গাজায় গণহত্যা, মানবিক সংকট ও অনাহার চলছে।’ যদিও ট্রাম্পপন্থী অন্যদের মধ্যে যেমন উগ্রপন্থী লরা লুমার দ্রুতই এর জবাবে লিখেছেন, ‘গাজায় কোনো গণহত্যা নেই।’

অতএব আলাস্কার এই ট্রাম্প-পুতিন শো রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে অন্তত সাময়িকভাবে দৃষ্টি সরাতে সক্ষম হয়েছে। তবে প্রহসনের কৌশল তো নতুন কিছু নয়। ট্রাম্পের বন্ধু নেতানিয়াহুই এই শিল্পের ওস্তাদ, গাজায় তার রক্তক্ষয়ী অভিযান আংশিকভাবে দেশীয় বিরোধিতা দমন এবং নিজের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ আড়াল করার জন্যই চালানো হচ্ছে।

শেষ পর্যন্ত আলাস্কার এই লালগালিচা অভিনয় বিশেষ কিছু ফল না দিলেও বিভ্রান্তি সৃষ্টির কৌশলই হয়তো জয়ী হবে। মানুষ ভাবতেই থাকবে, আসলেই ব্যাপারটা কী ছিল?

আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর : মাইসারা জান্নাত 
লেখক : বেলেন ফার্নান্দেজ, আল জাজিরা কলামিস্ট, গবেষক এবং বহু গ্রন্থের লেখক

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: