ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস
আলাস্কা সম্মেলন ‘নতুন মিউনিখ’ নয়, তবে হতে পারে ‘নতুন ইয়াল্টা’
প্রকাশ: ০০:৩২, ১৭ আগস্ট ২০২৫ | আপডেট: ১৮:০৭, ২২ আগস্ট ২০২৫

আজকের দিনে রাশিয়ার সেনারা বড় ধরনের সামরিক সাফল্য পেতে হিমশিম খাচ্ছে। ইউক্রেনে মাত্র কয়েকশ মিটার অগ্রসর হওয়ার জন্যও তাদের শত শত প্রাণ দিতে হচ্ছে, অনেক সময় একেবারেই অগ্রগতি হচ্ছে না।
তবে কূটনৈতিক মঞ্চে চিত্রটা ভিন্ন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন একটি বড় কূটনৈতিক জয় নিশ্চিত করেছেন।
আলাস্কার উষ্ণতা
আলাস্কার জয়েন্ট বেস এলমেনডর্ফ-রিচার্ডসনে আয়োজিত সম্মেলনে ছিল উষ্ণ অভ্যর্থনা। ট্রাম্প করতালি দিয়ে পুতিনকে লালগালিচায় স্বাগত জানান, তাকে প্রেসিডেন্সিয়াল লিমুজিনে উঠিয়ে দেন। তিন ঘণ্টার বৈঠকের পর উভয় নেতা বললেন তারা অনেক বিষয়ে একমত হয়েছেন। পুতিন ট্রাম্পকে মস্কো সফরের আমন্ত্রণও জানিয়েছেন, যদিও ট্রাম্প আপাতত তা মুলতবি রেখেছেন।
পুতিন মিডিয়াকে জানান, বৈঠক মূলত রাশিয়ার নিরাপত্তা উদ্বেগ কেন্দ্র করে হয়েছে এবং তিনি প্রশংসা করেছেন ট্রাম্পের “ইতিহাস বুঝতে চাওয়ার” মানসিকতার। রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেক্সান্ডার দারচিয়েভ জানিয়েছেন, ইউক্রেন ছাড়াও দুটি বড় বিষয় আলোচনায় এসেছে:
- বাইডেন আমলে বাজেয়াপ্ত করা ছয়টি রুশ কূটনৈতিক সম্পত্তি ফেরত দেওয়া,
- রাশিয়া-আমেরিকার সরাসরি বিমান চলাচল পুনরায় চালু করা।
ট্রাম্পের অবস্থান
বৈঠকের আগে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু সম্মেলনের পর তিনি যুদ্ধবিরতির বদলে রাশিয়ার চাওয়া অনুযায়ী ‘পূর্ণাঙ্গ শান্তি চুক্তি’র প্রস্তাব ইউক্রেন ও ইউরোপীয় মিত্রদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। ট্রাম্প পরে তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া ট্রুথ সোশ্যাল-এ লেখেন, ইউক্রেন ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাঁর সঙ্গে একমত যে, যুদ্ধ বন্ধের সেরা পথ হলো সরাসরি একটি শান্তিচুক্তি।
তবে ভয়ঙ্করতম আশঙ্কা—‘নতুন মিউনিখ’—ঘটে যায়নি। অর্থাৎ ১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ-ফরাসি নেতারা হিটলারকে যেমন আপিজমেন্ট করেছিলেন, তেমনটি ঘটেনি। ট্রাম্প রাশিয়ার ভূখণ্ড দখলের দাবিতে সায় দেননি।
পুতিনের কূটনৈতিক লাভ
তবু পুতিনের জন্য সম্মেলন একটি বড় কৌশলগত জয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট তাঁকে পুনরায় ‘মহাশক্তির নেতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। ২০২২ সালের একতরফা আগ্রাসন ও যুদ্ধাপরাধের কারণে যে আন্তর্জাতিক একঘরে দশা তৈরি হয়েছিল, তা ভেঙে এই বৈঠক রাশিয়াকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ফিরিয়ে আনল।
ইউক্রেন ও ইউরোপের সামনে সংকট
ট্রাম্প ইউক্রেন নিয়ে নিজের অবস্থান বদলাতে অনিচ্ছুক। তিনি পুতিনের ব্যক্তিত্ব ও শাসনধারাকে প্রশংসা করেন। তবু ব্রাসেলস, লন্ডন ও কিয়েভ তাঁকে এড়িয়ে যেতে পারবে না, কারণ মার্কিন সহায়তা ছাড়া ইউক্রেনের টিকে থাকা অসম্ভব। ইউরোপ অর্থায়নের বড় অংশ বহন করছে, কিন্তু সামরিক সক্ষমতায় এখনো যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প হতে পারছে না।
ট্রাম্প কেবল নামমাত্র শান্তি চান; কিয়েভের জন্য সেখানে টিকে থাকার প্রশ্ন জড়িত। আর ইউরোপের কাছে ইউক্রেন মানে সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ আগ্রাসন ঠেকানোর প্রাচীর।
ট্রাম্পকে কীভাবে প্রভাবিত করা যাবে?
ট্রাম্পের ইগো বা আত্মম্ভরিতায় তুষ্টি আনা তাকে প্রভাবিত করার উপায় হতে পারে—যেমনটি পুতিন করেছেন। ট্রাম্পের দৃষ্টি আসলে ইউক্রেন নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি রপ্তানি, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রভাব, এবং আর্কটিক অঞ্চলের দখল নিয়ে।
তাই কৌশল হবে ট্রাম্পকে বোঝানো—রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এসব স্বার্থের জন্য হুমকি:
- রাশিয়ার গ্যাস প্রকল্পগুলো বিশ্ববাজারে ঢুকলে মার্কিন এলএনজি রপ্তানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
- রাশিয়া চীনের অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতাকে শক্তিশালী করছে।
- রাশিয়া আর্কটিক দখলে নতুন সাবমেরিন ও আইসব্রেকার তৈরি করছে।
উপসংহার
পুতিনের যুদ্ধ কেবল ইউক্রেন সীমাবদ্ধ নয়; এটি বিশ্বব্যবস্থা পুনর্গঠনের যুদ্ধ। অপরদিকে, ট্রাম্পের কাছে যুদ্ধটা কেবল নিজের ‘বিশ্ব পুনর্গঠন প্রচেষ্টার’ পথে বাধা।
তাই ইউক্রেন ও পশ্চিমা বিশ্বকে বুঝতে হবে—কীভাবে ট্রাম্পকে বোঝানো যায় যে রাশিয়া আসলে আমেরিকার স্বার্থকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তা না হলে আলাস্কা সম্মেলন যদিও ‘নতুন মিউনিখ’ হয়ে ওঠেনি, তবু ইতিহাসে এটি হয়তো নতুন ‘ইয়াল্টা’ হিসেবে চিহ্নিত হবে—যেখানে ইউরোপের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে মস্কো-ওয়াশিংটনের আঁকা প্রভাবক্ষেত্র দিয়ে।
অনুবাদ : আল জাজিরা
ম্যাক্সিমিলিয়ান হেস,
ফরেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ফেলো