জাতিসংঘের উপমহাসচিব আমিনা মুহাম্মদ
বৈশ্বিক ক্ষুধা বৃদ্ধি, অস্ত্রে পরিণত হয়েছে খাদ্য
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১১:০৬, ১৮ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১১:০৮, ১৮ নভেম্বর ২০২৫
আমিনা মুহাম্মদ। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্বব্যাপী সংঘাতের ভয়াবহ প্রভাবে খাদ্য নিরাপত্তা এখন এক চরম সংকটের মুখে। জাতিসংঘের উপমহাসচিব আমিনা মুহাম্মদ সতর্ক করে বলেছেন, সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে সহিংসতা খাদ্য ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং কোটি কোটি মানুষকে তীব্র ও বিপর্যয়কর ক্ষুধার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। খাদ্য নিজেই এখন অস্ত্রে পরিণত হয়েছে।
সোমবার (১৭ নভেম্বর) কানাডার হ্যামিলটনে নিরাপত্তা পরিষদের এক বৈঠকে আমিনা মুহাম্মদ সংঘাত সম্পর্কিত খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার বিষয়ে কথা বলেন।
তিনি বলেন, যুদ্ধ ও ক্ষুধা একই সংকটের দুটি দিক। সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে আটকে থাকা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষের বাস্তব জীবন এই কঠিন সত্যকে নির্মম স্পষ্টতায় প্রতিফলিত করে।
আমিনা মুহাম্মদ ব্যাখ্যা করেন, সংঘাত কিভাবে খাদ্য প্রাপ্তির মূল ভিত্তিগুলোকে ধ্বংস করে। গুলি ও বোমা খাদ্য উৎপাদনকারী ফসলের মাঠ, ব্যবসার বাজার এবং কৃষকদের সাথে পরিবারের সংযোগকারী রাস্তাগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ক্ষুধা আবার সমান শক্তি নিয়ে আঘাত হানে। খালি পেট হতাশা বাড়ায়, আর সেই হতাশা আবার বাস্তুচ্যুতি ও সহিংসতাকে আরও ইন্ধন যোগায়। এর ফল হলো চরম অস্থিরতা এবং খাদ্য উৎপাদনকারী ব্যবস্থারই বিনাশ।
উপমহাসচিব জোর দিয়ে বলেন, ক্ষুধা বাড়তে থাকলে নিরাপত্তা পরিষদ তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সফলভাবে পালন করতে পারবে না।
তিনি সতর্ক করেন, যেখানে মানুষ না খেয়ে থাকে, সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। আর যেখানে ক্ষুধা সংঘাতকে চালিত করে, সেখানে নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা যায় না।
উদ্বেগজনক তথ্য তুলে ধরে তিনি জানান, বিশ্বব্যাপী ১৬টি ক্ষুধার্ত হটস্পটের মধ্যে ১৪টিতেই সশস্ত্র সংঘাত তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার প্রধান কারণ। গত বছর ২৯ কোটি ৫০ লাখ মানুষ তীব্র ক্ষুধার সম্মুখীন হয়েছিল, যা তার আগের বছরের তুলনায় ১ কোটি ৪০ লাখ বেশি।
এছাড়াও বিপর্যয়কর ক্ষুধার সম্মুখীন হওয়া মানুষের সংখ্যা ১.৯ মিলিয়নে পৌঁছেছে, যা দ্বিগুণেরও বেশি।
তিনি সুদান, গাজা, হাইতি, ইয়েমেন, সাহেল এবং ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অফ কঙ্গোর মতো অঞ্চলগুলিকে গুরুতর সংকটপূর্ণ বলে চিহ্নিত করেন। সুদানে বিশ্বের বৃহত্তম ক্ষুধা সংকটে সহিংসতা দারফুর এবং কর্ডোফানে দুর্ভিক্ষকে দীর্ঘায়িত করছে। গাজায় আগস্ট মাসে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছিল এবং সেখানকার পরিস্থিতি এখনো মারাত্মক। এসব অঞ্চলে লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষুধা ও সংঘাতের দুষ্ট চক্রে আটকা পড়ে আছে।
আঞ্চলিক সংকটের আন্তর্জাতিক প্রভাব সম্পর্কে আমিনা মুহাম্মদ হুঁশিয়ারি দেন, আমরা একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বে বাস করি, যেখানে এক অঞ্চলের সংঘাত অন্য মহাদেশেও তীব্র ঢেউ তোলে। তিনি এটিকে সংঘাতের নতুন পাটিগণিত হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, যখন খাদ্য ব্যবস্থার উপর হামলা হয় বা খাদ্যকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করা হয়, তখন তার প্রভাব বিশ্বব্যাপী অনুভূত হয়।
তিনি জানান, খাদ্যকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের কৌশলের মধ্যে রয়েছে-
১. ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে রাখার কৌশল, যা গাজাসহ বিভিন্ন স্থানে প্রায়শই দেখা যাচ্ছে।
২. কৃষি ব্যবস্থার পদ্ধতিগত ধ্বংস।
৩. সরবরাহে অবরোধ সৃষ্টি করা।
৪. বাণিজ্য প্রবাহকে হিসাব-নিকাশ করে ব্যাহত করা।
আমিনা মুহাম্মদ বিশ্ব সামরিক ব্যয়ের সাথে ক্ষুধা নিরসনের ব্যয়ের একটি তুলনা টেনে দেখান। গত দশকে বিশ্বের সামরিক ব্যয় অনুমান করা হয়েছে ২১.৯ মার্কিন ট্রিলিয়ন, অথচ ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা শেষ করতে বছরে খরচ হবে মাত্র ৯৩ মার্কিন বিলিয়ন।
তিনি বলেন, সংঘাতের মূল কারণগুলো মোকাবেলা না করে আমরা খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারি না এবং মানুষ নিজেদের খাদ্য নিশ্চিত করতে না পারলে আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে পারি না।
এই চরম ভোগান্তির মোকাবিলায় তিনি নিরাপত্তা পরিষদকে তাদের কর্তৃত্ব ও দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন।
নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতি হিসাবে সভায় সভাপতিত্বকারী সিয়েরা লিওনের প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস মাডা বায়ো বলেন, গাজা থেকে সাহেল, সুদান থেকে ইউক্রেন এবং হাইতির কিছু অংশে ক্ষুধাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, অনাহার কখনও সংঘাতের স্বাভাবিক ফল নয়। এটি হলো আইন ভঙ্গ করা এবং আমাদের সম্মিলিত মানবতার সঙ্গে বেইমানি করার ইচ্ছাকৃত সিদ্ধান্ত।
