বীণা দাস : অগ্নিকন্যার জন্মদিনে শ্রদ্ধা
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩:১৮, ২৪ আগস্ট ২০২৫

আজ ২৪ আগস্ট। আজকের দিনেই জন্ম নিয়েছিলেন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিকন্যা, নির্ভীক বিপ্লবী ও রাজনীতিবিদ বীণা দাস (১৯১১–১৯৮৬)। তার জীবনের প্রতিটি অধ্যায় ছিল সংগ্রাম, সাহস আর আত্মত্যাগের ইতিহাস। তিনি শুধু বিপ্লবী নন, ছিলেন একজন লেখক, সমাজকর্মী এবং নারী সমাজের অনুপ্রেরণা।
জন্ম ও পরিবার
বীণা দাসের জন্ম ১৯১১ সালের ২৪ আগস্ট নদীয়ার কৃষ্ণনগরে হলেও তাঁদের আদি নিবাস ছিল চট্টগ্রামে।
পিতা: বেণী মাধব দাস—ব্রাহ্মসমাজী পণ্ডিত, শিক্ষাবিদ ও দেশপ্রেমিক। তিনি কলকাতার রেভেনশ স্কুলের শিক্ষক হিসেবে জাতীয়তাবাদী ভাবধারার জন্য পরিচিত ছিলেন।
মাতা: সরলা দাস—প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিমনা নারী।
দিদি: কল্যাণী দাস—যুগান্তর দলের সক্রিয় বিপ্লবী।
পারিবারিক পরিবেশেই ছোটবেলা থেকে দেশপ্রেম, আত্মত্যাগ আর বিদ্রোহী চেতনার পাঠ নেন বীণা।
শিক্ষাজীবন ও রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ
বীণা দাস প্রথমে স্থানীয় স্কুলে পড়াশোনা করেন, পরে ভর্তি হন কলকাতার বেথুন কলেজে। এখানেই তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনা।
১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বর্জন আন্দোলন চলাকালে তিনি সহপাঠী লতিকা ঘোষকে সঙ্গে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের নেতৃত্ব দেন।
১৯৩০ সালে ডালহৌসির নিপীড়নবিরোধী আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন।
পরবর্তীতে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।
তরুণ বয়সেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শৃঙ্খল ভাঙা ছাড়া প্রকৃত স্বাধীনতা সম্ভব নয়।
১৯৩২: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় হত্যাচেষ্টা কাণ্ড
বীণা দাসের নাম ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে মূলত ১৯৩২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারির ঘটনায়।
সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ব্রিটিশ গভর্নর স্যার স্ট্যানলি জ্যাকসন বক্তব্য রাখছিলেন।
মাত্র ২১ বছর বয়সী বীণা তাঁর উপর পিস্তল তাক করে একাধিক গুলি চালান।
গভর্নর অল্পের জন্য বেঁচে যান, তবে গোটা ভারতবর্ষে তুমুল আলোড়ন তোলে এই ঘটনা।
উপাচার্য স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী তাঁর হাত ধরে ফেলায় তিনি ঘটনাস্থলেই ধরা পড়েন।
এই ঘটনার জন্য তাকে নয় বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জেলখানায় নির্যাতনের মধ্যেও তিনি অবিচল থাকেন এবং বন্দি সঙ্গীদের সাহস যুগিয়ে যান।
সাহিত্যকর্ম ও আত্মজীবনী
জেল থেকে মুক্তির পর তিনি লেখালেখিতেও মনোনিবেশ করেন। তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ “শৃঙ্খল ঝংকার” বিপ্লবী জীবনের দলিল। বইটিতে তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, জেলের জীবন ও রাজনৈতিক আদর্শের বর্ণনা দিয়েছেন।
রাজনীতি ও সামাজিক কাজ
১৯৪১-১৯৪৫: দক্ষিণ কলকাতা কংগ্রেসের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৪৬-১৯৫১: পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্য ছিলেন।
১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামী যতীশ ভৌমিককে বিয়ে করেন।
নোয়াখালির দাঙ্গার সময় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন।
স্বাধীনতার পরও তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। বিশেষত মরিচঝাঁপি গণহত্যার সময়ে তাঁর প্রতিবাদী ভূমিকা ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে।
সম্মাননা ও স্বীকৃতি
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী প্রদান করে।
স্বাধীনতার ইতিহাসে তিনি অগ্নিকন্যা নামে অমর হয়ে আছেন।
করুণ পরিণতি
স্বামী মৃত্যুর পর জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি চরম দারিদ্র্যের মধ্যে পড়েন।
১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঋষিকেশের পথে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
একসময় যে নারীকে ব্রিটিশ সরকার ভয় করত, যিনি কোটি মানুষের অনুপ্রেরণা ছিলেন, তাকেই জীবনের শেষ মুহূর্তে নিঃসঙ্গতা ও অভাবের মধ্যে দিন কাটাতে হয়েছিল—এ যেন ইতিহাসের নির্মম পরিহাস।
বীণা দাস ছিলেন সত্যিকার অর্থে অগ্নিকন্যা—নারী বিদ্রোহ, আত্মত্যাগ আর সাহসিকতার প্রতীক। তাঁর জীবন আজও আমাদের শেখায়—অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে ভয় নয়, প্রয়োজন দৃঢ় সংকল্প আর দেশপ্রেম।
আজ তার জন্মদিনে তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা মানেই আমাদের আগামী প্রজন্মকে নতুন উদ্যমে স্বাধীনতার চেতনা পৌঁছে দেওয়া।