বৃহস্পতিবার, ২৮ আগস্ট ২০২৫

| ১২ ভাদ্র ১৪৩২

আবহাওয়া বিজ্ঞানী আন্না মনি

সমাজকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ১৫:৪৬, ২৩ আগস্ট ২০২৫

আবহাওয়া বিজ্ঞানী আন্না মনি

আন্না মনি (Anna Mani) ছিলেন ভারতের আবহাওয়া গবেষণার পথিকৃৎ বিজ্ঞানী, যিনি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও সমাজের কল্যাণে। তাকে অনেকেই ভারতীয় আবহাওয়া বিজ্ঞানের "Weather Woman of India" বলে ডাকেন।

আন্না মোদায়িল মনি ১৯১৮ সালে পরমকুড়ি, রমনাথপুরমে এক প্রাচীন সিরিয়ান খ্রীষ্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।তার বাবা একজন পুরকৌশল বিশেষজ্ঞ এবং অজ্ঞেয়বাদী ছিলেন।তিনি তার পরিবারের আট সন্তানের মধ্যে সপ্তম ছিলেন।তার শৈশবকালে, তিনি প্রচুর পড়তেন। গান্ধীজীর ভৈকম সত্যাগ্রহ আন্দোলন দেখে তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন।জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে, তিনি শুধুমাত্র রেশম তন্তুর পোশাক পরতেন।

 প্রাথমিক গবেষণা ও বাধা অতিক্রম

পচাই কলেজ থেকে স্নাতক শেষ করার পর তিনি অধ্যাপক সলোমন পাপ্পাইয়ার তত্ত্বাবধানে কাজ শুরু করেন। সেখানে তিনি রুবি ও হীরকের আলোক বৈশিষ্ট্য নিয়ে গবেষণা করেন এবং পাঁচটি গবেষণা পত্র লিখে পিএইচডি জমা দেন। কিন্তু তার পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি না থাকায় তাকে ডিগ্রি দেওয়া হয়নি। এই বাধা তাঁকে থামাতে পারেনি।

১৯৪৮ সালে ভারতে ফিরে তিনি পুনের আবহাওয়া দপ্তরে যোগ দেন। সেখানেই শুরু হয় তার বৈজ্ঞানিক অবদানের সবচেয়ে বড় অধ্যায়।


আবহাওয়া যন্ত্রের মান নির্ধারণে অগ্রদূত

তখনকার সময়ে ভারত পুরোপুরি ব্রিটেন থেকে আমদানি করা যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল ছিল। আন্না মনি এই নির্ভরশীলতা ভাঙতে চাইলেন। তিনি প্রায় ১০০টির বেশি আবহাওয়া যন্ত্রের নকশা ও ব্যবহারকে মানসম্মত করেন।

১৯৫৩ সালের মধ্যে তিনি আবহাওয়া বিভাগের প্রধান হন এবং তাঁর নেতৃত্বে ১২১ জন পুরুষ কর্মী কাজ করতেন—যা সেই সময়ে নারী নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বিরল এক দৃষ্টান্ত।


সৌর শক্তি ও পরিবেশ গবেষণায় অবদান

১৯৫৭–৫৮ সালে তিনি সৌর বিকিরণ পরিমাপের জন্য একটি ন্যাশনাল নেটওয়ার্ক অব স্টেশন স্থাপন করেন। ব্যাঙ্গালোরে একটি ছোট ওয়ার্কশপ গড়ে তুলে তিনি বায়ু ও সৌর শক্তি পরিমাপের যন্ত্র বানান।

পরে তিনি ওজোন পরিমাপের জন্য যন্ত্র উদ্ভাবন করেন এবং আন্তর্জাতিক ওজোন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হন। তাঁর প্রচেষ্টায় থুম্বা রকেট লঞ্চিং সেন্টারে আবহাওয়া মাপার বিশেষ স্তম্ভ স্থাপন করা হয়।


আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

আন্না মনি শুধু ভারতের নয়, বৈশ্বিক আবহাওয়া গবেষণার ক্ষেত্রেও পরিচিত নাম। তিনি যুক্ত ছিলেন:

  • ভারতীয় জাতীয় বিজ্ঞান একাডেমী (INSA)
  • আমেরিকান মেটিওরোলজিকাল সোসাইটি
  • ইন্টারন্যাশনাল সোলার এনার্জি সোসাইটি
  • বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO)


১৯৮৭ সালে তিনি আইএনএসএ কে. আর. রমনাথন পদক পান।


 গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা

তাঁর গবেষণার ফলাফল একাধিক গ্রন্থে স্থান পেয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য—

  • Solar Radiation Over India (১৯৮১)
  • The Handbook for Solar Radiation Data for India (১৯৮০)
  • Wind Energy Resource Survey in India (১৯৯২)


এই বইগুলো আজও পরিবেশ, সৌরশক্তি ও আবহাওয়া গবেষণায় রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

 ব্যক্তিজীবন ও উত্তরাধিকার

আজীবন নিজের কাজে নিবেদিত আন্না মনি কখনো বিয়ে করেননি। ১৯৭৬ সালে ভারতীয় আবহাওয়া বিভাগের ডেপুটি মহাপরিচালক পদ থেকে অবসর নেন। ২০০১ সালের ১৬ আগস্ট তিরুবনন্তপুরমে তার মৃত্যু হয়।

২০০১ সালে তার মৃত্যুর পরও বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা (WMO) তাঁর জীবন ও অবদানের স্বীকৃতি দেয় এবং শতবর্ষে তাঁকে বিশেষভাবে স্মরণ করে।


আন্না মনি দেখিয়েছেন কীভাবে এক নারী সমস্ত প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে বিজ্ঞানের জগতে অমলিন ছাপ রেখে যেতে পারেন। ভারতের আবহাওয়া গবেষণা ও সৌরশক্তি উন্নয়নের ভিত্তি তাঁর হাতেই গড়ে ওঠে।

 আজকের দিনে যখন টেকসই শক্তি ও জলবায়ু পরিবর্তন মানব সভ্যতার বড় চ্যালেঞ্জ, তখন আন্না মনির অবদান নতুন প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার বাতিঘর।

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ: