সেন্ট মার্টিনে পর্যটক প্রবেশের অনুমতি, মানতে হবে ১২ নির্দেশনা
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২:২৯, ২৯ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১২:৪৫, ২৯ অক্টোবর ২০২৫
প্রবালপ্রাচুর্যে ঘেরা বঙ্গোপসাগরের বুকে অবস্থিত দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন আবারও খুলে দেওয়া হচ্ছে পর্যটকদের জন্য। দীর্ঘ নয় মাস বন্ধ থাকার পর আগামী ১ নভেম্বর থেকে প্রতিদিন সর্বোচ্চ দুই হাজার পর্যটক দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন। তবে পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে সরকার নির্ধারিত ১২টি নির্দেশনা কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।
ভ্রমণ সময়সীমা ও নিয়ম
সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, নভেম্বর মাসে শুধুমাত্র দিনের বেলায় ভ্রমণ করা যাবে, রাতযাপন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। তবে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি—এই দুই মাস দ্বীপে রাতযাপনের অনুমতি থাকবে। এরপর ১ ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী নয় মাসের জন্য আবারও পর্যটন কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
কক্সবাজার থেকে জাহাজ চলাচল
নিরাপত্তার কারণে এবারে টেকনাফ নয়, বরং কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজে সেন্ট মার্টিনে যাওয়া যাবে।
বিআইডব্লিউটিএ এবং পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো নৌযান চলাচল করতে পারবে না। পর্যটকদের বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত অনলাইন পোর্টাল থেকে ট্রাভেল পাস ও কিউআর কোডসহ টিকিট কিনতে হবে; কিউআর কোডবিহীন টিকিট অকার্যকর হিসেবে গণ্য হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে কঠোর নির্দেশনা
দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১২ দফা নির্দেশনা জারি করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলো—
রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বারবিকিউ পার্টি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ।
কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল বা শামুক–ঝিনুক সংগ্রহ ও বিক্রয় নিষিদ্ধ।
সৈকতে মোটরসাইকেল, সি–বাইক বা যেকোনো মোটরচালিত যান চলাচল বন্ধ থাকবে।
পলিথিন ও একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক (চিপসের প্যাকেট, মিনিপ্যাক, প্লাস্টিক বোতল, চামচ, স্ট্র ইত্যাদি) বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে।
পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
পরিবেশের উন্নতি ও জীববৈচিত্র্যের পুনরুজ্জীবন
গত ৯ মাস পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকায় সেন্ট মার্টিনের পরিবেশে লক্ষণীয় পরিবর্তন এসেছে। দ্বীপজুড়ে লাল কাঁকড়া, শামুক–ঝিনুক ও মা কাছিমের বংশবিস্তার বেড়েছে।
পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, দ্বীপে ১,০৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে—প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, পাখি ও স্তন্যপায়ী প্রাণীসহ।
ইয়ুথ এনভায়রনমেন্ট সোসাইটির নির্বাহী ইব্রাহিম খলিল বলেন, “পর্যটক সীমিত করার উদ্যোগে সেন্ট মার্টিনের সৈকত এখন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। মা কাছিমের ডিম পাড়ার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।”
উন্নয়ন প্রকল্প ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বর্তমানে দ্বীপে চলছে ৮ কোটি ৯০ লাখ টাকার ‘জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু অভিযোজন প্রকল্প’।
প্রকল্প পরিচালক কামরুল হাসান জানান, ছেঁড়াদিয়া ও দিয়ারমাথা এলাকায় প্রবাল ও শৈবালের বিস্তার চোখে পড়ছে, নতুন করে প্যারাবন গড়ে উঠছে।
এ ছাড়া দ্বীপে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পানীয় জলের সংকট নিরসন, কুকুর বন্ধ্যাকরণ, বনায়ন ও নতুন জেটি নির্মাণসহ শত কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন আছে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ
দ্বীপের হোটেল ও দোকান মালিকেরা জানিয়েছেন, নভেম্বর মাসে রাতযাপনের অনুমতি না থাকায় বেচাকেনা প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে।
হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি শিবলুল আযম কোরেশী বলেন, “পরিবেশ রক্ষা জরুরি, কিন্তু জীবিকার বিকল্প ব্যবস্থা ছাড়া পর্যটন খাত টিকবে না।”
তাঁরা আগের মতো অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাসের জন্য রাতযাপনের অনুমতি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছেন।
সেন্ট মার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষা ও টেকসই পর্যটন নিশ্চিত করতে এবার সরকারের পদক্ষেপ প্রশংসনীয় হলেও, স্থানীয় জনগণের জীবিকা রক্ষা এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষায় সামঞ্জস্যপূর্ণ নীতি গ্রহণের দাবি উঠেছে।
সবশেষে, পর্যটকদের দায়িত্বশীল আচরণই নির্ধারণ করবে—এই ছোট্ট প্রবাল দ্বীপটি টিকে থাকবে সৌন্দর্যের প্রতীকে, নাকি হারাবে নিজের স্বরূপ।
