ইলা মিত্র দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন—নারীমুক্তির পথ একমাত্র সমাজতন্ত্রেই নিহিত
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০২:১৮, ১৩ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২০:৪৪, ১৩ নভেম্বর ২০২৫
সংগ্রামী ইলা মিত্রের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানে ১২ নভেম্বর তাঁর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেত্রীবৃন্দ। ছবি: সংগৃহিত
বিপ্লবের দূত ইলা মিত্র এক প্রেরণার নাম, যিনি সাম্যবাদী আদর্শকে নিজের জীবনাচরণে পরিণত করে হয়ে উঠেছেন কিংবদন্তি। মানুষের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস তাকে বৈষম্যহীন সমাজ নির্মাণে যুগিয়েছে অনুপ্রেরণা। নারীমুক্তির পথ একমাত্র্র সমাজতন্ত্রেই নিহিত - তাঁর এই দৃঢ় বিশ্বাস করণীয় নির্ধারণে আমাদের গভীরভাবে ভাবতে শেখায় বলে মন্তব্য করেছেন আলোচকেরা।
আজ বুধবার (১২ নভেম্বর,২০২৫) বিকেলে ‘তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্রের জন্মশতবর্ষ পালন’ উপলক্ষে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ আয়োজিত আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এসব মন্তব্য করেন আলোচকেরা ।
মহিলা পরিষদের সেগুনবাগিচাস্থ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সুফিয়া কামাল ভবনের আনোয়ারা বেগম- মুনিরা খান মিলনায়তনে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতেই তেভাগা আন্দোলনের বিপ্লবী নেত্রী ইলা মিত্র’র প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান মহিলা পরিষদের নেত্রীবৃন্দ ও আগত অতিথিবৃন্দ। এরপর তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব গড়ে তুলতে ইলা মিত্রের বিপ্লবী কর্মজীবনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র ‘রানীমা’প্রদর্শন করা হয়। প্রদর্শনী শেষে কবিতা আবৃত্তি করেন স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আবৃত্তিকার নায়লা তারান্নুম চৌধুরী। সংগীত পরিবেশনা করেন বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী থেকে সংগীত ও নৃত্য বিষয়ক সম্পাদক সুরাইয়া পারভীন ও তার দল।
আলোচনা সভার পুরোটা জুড়েই ইলা মিত্রের কঠিন জীবন সংগ্রাম ও কর্মের নানা দিক এবং প্রমাণ্যচিত্রে তার নানা উদ্বৃতি বক্তাদের বক্তব্যে উঠে এসেছে বার বার। তারা ব্যাখা করেছেন, কলকাতায় লেখাপড়া করা অভিজাত পরিবারে জন্ম নেয়া এক জমিদার বধূ, একসময় কি করে হয়ে উঠলেন তেভাগা আন্দোলনের এক বিপ্লবী নেত্রী।
স্বাগত বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, ইলা মিত্রের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে চাষী ও সাওতালদের সাথে থেকে তাদের জীবনাআচার শেখার মাধ্যমে বিশ্বাস অর্জনই ছিলো মুখ্য বিষয়। অথচ সাম্প্রদায়িকতা ও নারী হওয়ার কারণে এই আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি নির্মম নির্যাতন ও অত্যাচারের শিকার হন। এত আন্দোলন, সংগ্রাম ও নির্যাতনের পরও তিনি নিজের আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি, যা আজকের দিনের নারী আন্দোলন কর্মীদের জন্য অনুসরণীয়।
নিজেরা করি এর প্রধান সমন্বয়কারী খুশী কবির বলেন, ইলা মিত্র আমাদের জন্য এক কিংবদন্তী। আমার নিজের কর্মজীবনে এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর আত্মত্যাগ আমাকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল। অথচ তিনি নিজেকে প্রচারের লক্ষ্যে কখনও কাজ করেনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ঈষানী চক্রবর্তী বলেন, তেভাগা আন্দোলন, নাচোল ও ইলা মিত্র একই সূত্রে গাঁথা। নানা মুখী প্রতিভার অধিকারী ইলা মিত্র জীবনে যখন যে কাজই করেছেন, সেখানেই সফলতার ছাপ রেখেছেন। তেভাগা আন্দোলনের মাধ্যমে কৃষকদের অধিকার আদায়ে তিনি বিভিন্ন অধিকারবঞ্চিত শ্রেণীর মানুষদের সংগঠিত করতে সক্ষম হন ও তাদের আস্থা অর্জন করেন। নাচোলে পরিচিত হন রাণীমা হিসেবে। আন্দোলনের সময়ের পরিক্রমায় তার ব্যক্তি সাহসিকতা সামষ্টিক সাহসকে তুলে ধরেছিলো। তাকে কেবল আমাদের স্মরণ করলেই হবেনা, আমাদের কাজের মধ্য দিয়ে ধারণ করতে হবে, চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে হবে।
বহ্নিশিখা গ্রীন ভয়েস সমন্বয়ক আলমগীর হোসাইন বলেন, ইলা মিত্রের জীবন একই সাথে বিশাল গৌরবের ও নারকীয়। নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ত্যাগের এক অসাধারণ জীবনগাথায় পূর্ণ ছিলো তাঁর জীবন। এই প্রজন্মের তরুণদের প্রত্যেকেরই ইলা মিত্র সম্পর্কে জানা প্রয়োজন, কারণ তিনি এক অনুপ্রেরণার নাম।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, ব্রিট্রিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হলেও এদেশে সাম্প্রদায়িকতা থেকেই গেছে। আজ নানা রকম হিংসা, বিদ্বেষ এর মূলে এই সাম্প্রদায়িকতা। এই হিংসার, ঘৃণার সমাজকে বদলাতে সাম্পদায়িকতার বিরুদ্ধের আন্দোলনকে শক্তিশালী করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি তরুণদের কে সমাজের বিষয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। তিনি আরো বলেন, ইলা মিত্র বলতেন-সমাজতন্ত্রের মধ্যে নারীমুক্তি নিহিত। কিন্তু সমাজতন্ত্রের মধ্যে নারীমুক্তি কিভাবে হবে সেবিষয়ে আমাদের আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে ও করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন মহিলা পরিষদের সহসভাপতি মাখদুমা নার্গিস। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মহিলা পরিষদের প্রকাশনা সম্পাদক সারাবান তহুরা।
এছাড়াও আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নি:সঙ্কোচ ফাউন্ডেশন, ওয়াইডব্লিউসিএ অব বাংলাদেশ, কর্মজীবী নারী রিফিউজি এন্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্স ইউনিট (রামরু), গ্রীণ ভয়েস বহ্নিশিখার প্রতিনিধি, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের নেতৃবৃন্দ, সম্পাদকমন্ডলী, কর্মকর্তা এবং প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন।
