যুগ বদলের সাহিত্যস্রষ্টা হোর্হে লুইস বোর্হেস
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩:১৫, ২৪ আগস্ট ২০২৫

হোর্হে লুইস বোর্হেস শুধু একজন সাহিত্যিক নন, তিনি ছিলেন যুগ বদলের স্রষ্টা। অন্ধত্ব তাকে থামাতে পারেনি, বরং দিয়েছে নতুন দৃষ্টি। তার লেখনী আজও বিশ্বসাহিত্যে আলোকবর্তিকা হয়ে আছে।
সাহিত্য-ভাবনার বিপ্লবী রূপকার
“বোর্হেসের প্রভাব এড়িয়ে লাতিন আমেরিকায় লিখছেন—এমন লেখক নেই।” লাতিন আমেরিকার খ্যাতনামা লেখক কাব্রেবা ইনফান্তের এই মন্তব্য বোর্হেসকে বোঝার অন্যতম চাবিকাঠি। স্প্যানিশ সাহিত্যে দোন কিহোতে–র স্রষ্টা সের্ভান্তেসের পর যিনি মৌলিকতার আলো ছড়িয়েছেন, তিনি হোর্হে লুইস বোর্হেস। শুধু আর্জেন্টিনা নয়, গোটা বিশ্বসাহিত্যে তিনি এনে দিয়েছেন কল্পনার নতুন মাত্রা, দর্শন আর সাহিত্যকে মিলিয়ে রচনা করেছেন ভিন্ন এক বিশ্ব।
জন্ম ও পরিবার
১৮৯৯ সালের ২৪ আগস্ট বুয়েনস আইরেসের পালেরমো জেলায় জন্ম নেন বোর্হেস। পিতা ছিলেন আইনজীবী ও দার্শনিক, মা ছিলেন ক্যাথলিক পরিবার থেকে আসা, যিনি আবার উরুগুয়ে বংশোদ্ভূত। ইংরেজ দাদীর কারণে শৈশবেই ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠেন তিনি। পরিবারের বিশাল গ্রন্থাগার হয়ে ওঠে তার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়, যেখানে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের অসংখ্য বই তাঁকে গড়ে তোলে অনন্য সাহিত্যমানসে।
লেখালেখির সূচনা
মাত্র ছয়-সাত বছর বয়সে তার প্রথম গল্পলেখা শুরু। নয় বছর বয়সে অস্কার ওয়াইল্ডের হ্যাপি প্রিন্স–এর স্প্যানিশ অনুবাদ প্রকাশিত হয় দৈনিক এল পাইস–এ। অল্প বয়সেই তার সাহিত্য প্রতিভা ধরা দেয়, যা পরবর্তী সময়ে নতুন ধারার সূচনা করে।
ইউরোপের শিক্ষা ও সাহিত্যভ্রমণ
১৯১৪ সালে পরিবার নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমান বোর্হেস। জেনেভার কলেজ অব জেনেভাতে পড়াশোনা শুরু করেন। ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান ও লাতিন ভাষা শেখার পাশাপাশি সেসব ভাষার সাহিত্যও গিলেছেন গোগ্রাসে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ছায়ায় কাটানো এই সময়কাল তার সাহিত্যচিন্তায় গভীর প্রভাব ফেলে।
রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অন্ধত্ব
আর্জেন্টিনায় স্বৈরশাসক পেরোনের সময় ভিন্নমত প্রকাশের কারণে নানা হয়রানি সয়েছেন বোর্হেস। তবে সবচেয়ে বড় লড়াই ছিল ব্যক্তিগত—পরিবারগত রোগ অন্ধত্বে আক্রান্ত হন তিনি। ১৯৫০–এর দশকে পুরোপুরি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েও তিনি কবিতা ও প্রবন্ধে নতুন সৃষ্টিশীল শক্তি খুঁজে পান। অন্ধকারই হয়ে ওঠে তাঁর কাব্যের আলো।
বিশ্বসাহিত্যে উত্থান
১৯৬১ সালে স্যামুয়েল বেকেটের সঙ্গে ফোর্মেন্তোর পুরস্কার লাভের পর আন্তর্জাতিক পরিসরে আলোচিত হয়ে ওঠেন বোর্হেস। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড, টেক্সাস ও ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেন তিনি। ১৯৭৯ সালে তাঁর ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে আর্জেন্টিনার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করে। ১৯৮০ সালে পান স্প্যানিশ সাহিত্যের সর্বোচ্চ পুরস্কার—মিগেল দে সের্ভান্তেস পুরস্কার।
ব্যক্তিগত জীবন ও প্রয়াণ
বোর্হেস জীবনে দুবার বিয়ে করেছিলেন—প্রথমে এলসা আস্তেতে মিলানকে, পরে সহযোগী মারিয়া কোদামাকে, যার সঙ্গে তিনি মৃত্যুর কয়েক মাস আগেই বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তার কোনো সন্তান ছিল না। ১৯৮৬ সালের ১৪ জুন জেনেভাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
সাহিত্য উত্তরাধিকার
বোর্হেসের সাহিত্য শুধু গল্প বা কবিতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না; তিনি দর্শন, কল্পনা ও ভাষার খেলাকে একত্রিত করে নতুন এক সাহিত্যরীতি গড়ে তুলেছিলেন। তার লেখায় জটিল দার্শনিক ধাঁধা, সময়ের অস্থিরতা, অসীমতার ধারণা, আয়না, গোলকধাঁধা ও অনন্তের প্রতীক ঘুরে ফিরে এসেছে। আজও তিনি বিশ্বসাহিত্যের অদৃশ্য শিক্ষক, যার প্রভাব ছাড়াই লাতিন আমেরিকা তো বটেই, সমগ্র আধুনিক সাহিত্যের ইতিহাস কল্পনা করা অসম্ভব।