রোববার, ১৬ নভেম্বর ২০২৫

| ১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩২

বিবিসির প্রতিবেদন

শেখ হাসিনা: গণতন্ত্রকামী আইকন থেকে স্বৈরশাসকে রূপান্তর

সমাজকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৬:৩৯, ১৪ নভেম্বর ২০২৫

শেখ হাসিনা: গণতন্ত্রকামী আইকন থেকে স্বৈরশাসকে রূপান্তর

শেখ হাসিনা

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে দেশ ত্যাগ করেন বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকেই তিনি ভারতে অবস্থান করছেন। 
এরমধ্যে অন্তবর্তীকালীন সরকার শেখ হাসিনাসহ জুলাই হত্যাকাণ্ড নিয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে বিচার শুরু করে। বিচারিক কার্যক্রম প্রায় শেষের দিকে। আগামী সোমবার শেখ হাসিনাসহ তিন জনের রায় ঘোষণার তারিখ জানিয়েছে।
এই রায়ে প্রসিকিউশন সর্বোচ্চ শাস্তির প্রত্যাশার কথা জানিয়েছে। এই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো। 
রায়ের প্রাক্কালে আজ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি শেখ হাসিনাকে নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেটি সমাজকালের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো। 

শেখ হাসিনা ওয়াজেদ—বাংলাদেশের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রী। তার রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে। কিন্তু ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার  গণবিক্ষোভের মুখে দেশ ছাড়তে বাধ্য হন তিনি।

ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে হাসিনা ভারতেই স্বেচ্ছা নির্বাসনে আছেন।  ছাত্রদের নেতৃত্বাধীন আন্দোলন যে বড় রাজনৈতিক অস্থিরতায় রূপ নিয়েছিল, তার পরপরই তিনি উড়োজাহাজে দেশত্যাগ করেন।

আগামী সোমবার বাংলাদেশের একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার বহুল প্রতিক্ষিত রায় ঘোষণা করবে। তিনি অভিযোগগুলো অস্বীকার করেছেন।
অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার দাবি তুলেছেন প্রসিকিউটররা।

জাতিসংঘের মানবাধিকার তদন্তকারীদের মতে, তার অপসারণের আগে কয়েক সপ্তাহে সংঘটিত বিক্ষোভে প্রায় ১,৪০০ মানুষ নিহত হয়। তারা বলেছেন, ক্ষমতায় টিকে থাকতে হাসিনা ও তার সরকার পরিকল্পিতভাবে বিক্ষোভকারীদের ওপর প্রাণঘাতী সহিংসতা চালিয়েছিল।

এই আন্দোলনেই অপ্রত্যাশিতভাবে হাসিনার দুই দশকের শাসনের অবসান ঘটে।

তিনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য প্রশংসা পেয়েছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তার বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আচরণ এবং বিরোধী মত দমনের অভিযোগ তীব্র হয়েছে।

তার শাসনামলে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত গ্রেপ্তার, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বিভিন্ন ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ বেড়েছে।


‘প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার’ করার নির্দেশ

২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে হাসিনা নজিরবিহীনভাবে চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় ফেরেন—যে নির্বাচনকে বিরোধীদল ও আন্তর্জাতিক মহলের অনেকেই 'প্রহসন' বলে আখ্যা দিয়েছিলেন এবং প্রধান বিরোধী দল নির্বাচন বর্জন করেছিল।

বিক্ষোভ শুরু হয় পরে, সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিকে কেন্দ্র করে। কয়েক মাসের মধ্যে তা বৃহত্তর সরকারবিরোধী আন্দোলনে পরিণত হয়, কারণ হাসিনা আন্দোলন দমনে পুলিশের উপর নির্ভর করে সহিংস দমননীতি চালু করেন।

তার পদত্যাগের দাবিতে চাপ বাড়তে থাকলেও হাসিনা অবস্থান নেন কঠোরভাবে—বিক্ষোভকারীদের তিনি ‘সন্ত্রাসী’ বলেন। হাজার হাজার মানুষকে আটক করা হয়, এবং আরও অনেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দেওয়া হয়।

একটি ফাঁস হওয়া অডিওতে তাকে নাকি পুলিশকে “প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার” করতে নির্দেশ দিতে শোনা গেছে—যদিও তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।

সর্বাধিক রক্তক্ষয়ী ঘটনাগুলোর একটি ঘটেছিল ৫ আগস্ট—সেদিনই হাসিনা হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়েন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিক্ষোভকারীরা ঢাকায় তার সরকারি বাসভবন দখল করে। সেদিন রাজধানীর ব্যস্ত এলাকায় পুলিশ কমপক্ষে ৫২ জনকে হত্যা করে—যা দেশের পুলিশি সহিংসতার ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা।

বাংলাদেশে অনুপস্থিত থাকায় হাসিনাকে এই মামলায় অনুপস্থিত আসামি হিসেবে বিচার করা হচ্ছে। তিনি অভিযোগগুলো ‘ভিত্তিহীন’ বলে নাকচ করেছেন।

তিনি বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন,
“এটি আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের নিয়ন্ত্রিত একটি প্রহসনের আদালত। আগেই নির্ধারিত দোষী রায় দেওয়ার জন্য এই নাটক সাজানো হয়েছে… নতুন সরকারের বিশৃঙ্খলা, সহিংসতা ও কুশাসন থেকে বিশ্ববাসীর নজর সরাতে এটি করা হচ্ছে।”

হাসিনার বিরুদ্ধে আরেকটি মামলায় তার সরকারের আমলে সংঘটিত গুমের ঘটনাকেও মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে অভিযুক্ত করা হয়েছে—যা তিনি ও আওয়ামী লীগ উভয়েই অস্বীকার করেছে।

এছাড়াও তিনি ও তার সরকারের আরও কয়েকজন শীর্ষ নেতা দুর্নীতির আরেকটি মামলায় অভিযুক্ত—যা তারা নাকচ করেছেন।

হাসিনা কীভাবে ক্ষমতায় আসেন?
১৯৪৭ সালে পূর্ববঙ্গে জন্ম নেওয়া শেখ হাসিনা একটি রাজনৈতিক পরিবার থেকে উঠে আসেন।

তার বাবা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান—বাংলাদেশের স্থপতি, যিনি পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা এনে দেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই হাসিনা ছাত্রনেত্রী হিসেবে পরিচিতি পান।

১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে তার বাবা-মাসহ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যকে হত্যা করা হয়। দেশে না থাকায় বেঁচে যান শুধু তিনি ও তার ছোট বোন।

ভারতে নির্বাসনে থাকার পর ১৯৮১ সালে তিনি দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন গড়ে তোলেন। এ আন্দোলন তাকে দ্রুত জাতীয় নেত্রীতে পরিণত করে।

১৯৯৬ সালে তিনি প্রথমবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
ভারতের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির জন্য তিনি প্রশংসিত হন।

তবে একই সময়ে তার সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এবং ভারতঘেঁষা নীতি নেওয়ার সমালোচনাও হয়।

২০০১ সালে তার প্রাক্তন মিত্র বেগম খালেদা জিয়ার কাছে তিনি পরাজিত হন।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে দুই নেত্রীর দীর্ঘ প্রতিদ্বন্দ্বিতা—‘বেগমদের যুদ্ধ’—বোমা হামলা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং সহিংসতাকে যেন নিত্যদিনের ঘটনায় পরিণত করেছিল।

২০০৯ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা আবার ক্ষমতায় ফেরেন।

রাজনীতিতে এক দুর্দান্ত টিকে থাকা ব্যক্তিত্ব হিসেবে হাসিনা বহুবার গ্রেপ্তার, ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলাসহ হত্যাচেষ্টায় বেঁচে যাওয়া, নির্বাসনের চাপ ও দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হওয়া—সবই মোকাবিলা করেন।

সাফল্য ও বিতর্ক
কখনো বিশ্বের দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ ২০০৯ সালের পর হাসিনার নেতৃত্বে উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জন করে।

গত এক দশকে দেশের মাথাপিছু আয় তিন গুণ হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে, গত ২০ বছরে ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচ থেকে উঠে এসেছে।

বস্ত্রশিল্পের দ্রুত সম্প্রসারণই এ উন্নতির প্রধান চালিকাশক্তি—যা এখনো দেশের রপ্তানির বৃহত্তম খাত এবং ইউরোপ-উত্তর আমেরিকা-এশিয়ার বাজারে সরবরাহ করে।

সরকার নিজস্ব অর্থ, ঋণ ও আন্তর্জাতিক সহায়তায় বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণ করে—যার মধ্যে ২.৯ বিলিয়ন ডলারের পদ্মা সেতু অন্যতম।

কিন্তু এই সাফল্যের পাশাপাশি হাসিনার বিরুদ্ধে অভিযোগও পাল্লা ভারী।
গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামী নেতা থেকে তিনি ধীরে ধীরে হয়ে ওঠেন এক ক্ষমতাকেন্দ্রিক শাসক।

মানবাধিকার সংস্থাগুলোর হিসাব অনুযায়ী, ২০০৯ সালের পর থেকে অন্তত ৭০০ গুম এবং শত শত বিচারবহির্ভূত হত্যার ঘটনা ঘটেছে—যা হাসিনা অস্বীকার করেছেন।

২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়—গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে।

মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও বিরোধী মতের মানুষদের ওপর নজরদারি, হয়রানি ও গ্রেপ্তারের অভিযোগও ক্রমেই বাড়ে।

নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসসহ সমালোচকদের বিরুদ্ধে মামলা করাকে অনেকে ‘বিচারিক হয়রানি’ হিসেবে দেখেছেন। হাসিনার সরকার এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বিদেশি সাংবাদিকদের তথ্য অনুসন্ধানে নানা বাধাও দিয়েছে।

কোটা সংস্কারবিরোধী আন্দোলন যে গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়, তার পেছনেও ছিল অর্থনৈতিক চাপ—মহামারি-পরবর্তী সময়ে মূল্যস্ফীতির ভয়াবহ বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা এবং ২০১৬ সালের পর বিদেশি ঋণ দ্বিগুণ হওয়া।

সমালোচকদের দাবি, অর্থনৈতিক অগ্রগতি হয়েছিল মূলত ক্ষমতাসীনদের উপকারে; সাধারণ মানুষের অবস্থা ততটা উন্নত হয়নি।

সম্পর্কিত বিষয়:

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

চাঁপাইনবাবগঞ্জে জুলাই সনদ বাস্তবায়নসহ ৫ দফা দাবিতে জামায়াতের মিছিল
আসিফ আকবরের ‘ফুটবল বিদ্বেষী’ বক্তব্যের প্রতিবাদে চট্টগ্রামে মানববন্ধন
বিশ্বমঞ্চের লাইমলাইট চুরি করেছেন ঐশ্বরিয়া রাই একাই…
তারেক রহমান ক্ষমতায় এলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিশ্চিত হবে
সীতাকুণ্ডে ঝোপের ভেতর পরিত্যক্ত অবস্থায় ৩ পাইপগানসহ দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার করল র‌্যাব-৭
আমরা ইউনূসের সনদ রিজেক্ট করেছি। আমরা জনতার সনদ তৈরি করব : সেলিম
রাজধানীতে নাশকতার প্রস্তুতি, নিষিদ্ধ আ.লীগের ৫ নেতাকর্মী গ্রেফতার
সরকার দরদ দেখিয়েছে, দায় দেখায়নি’ — নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী
বিশ্ববাজারে স্বর্ণের দাম কমল, বিনিয়োগকারীদের মনে অনিশ্চয়তা
ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন: ‘পোস্টাল ভোট বিডি’ অ্যাপে নিবন্ধনের সময় ৪ সপ্তাহ
জেনেভা ক্যাম্পে গোপন কারখানা থেকে ৩৫ ককটেল উদ্ধার
কেন্দ্রীয় কারাগারে অসুস্থ হয়ে কয়েদির মৃত্যু
বাংলাদেশকে হারিয়ে বিশ্বকাপ বাছাই নিশ্চিত করল পাকিস্তান
শয্যাশায়ী ধর্মেন্দ্রর ভিডিও ফাঁস তীব্র ক্ষোভে অমিতাভ–জয়া বচ্চন
হাসিনার রায় ঘোষণায় বিশৃঙ্খলা হলে দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর—আমির খসরু
রঙ্গনার ফুটেজ ফাঁস: ক্ষুব্ধ শাবনূর
‘তিন উপদেষ্টা সঠিক নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করছেন’—অপসারণের দাবিতে ডা. তাহের
ক্যালিফোর্নিয়ার নতুন ভোটিং মানচিত্রে ‘ডেমোক্র্যাট সুবিধা’ মামলা করল ইউএস জাস্টিস ডিপার্টমেন্ট
একাধিক শিক্ষার্থীকে যৌন হেনস্তার অভিযোগে ঢাবি শিক্ষক এরশাদ হালিম আদালতে চালান
সুদান সংকট নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ বাড়ছে, আল-ফাশির ঘটনায় তদন্তের দাবি তীব্র