সিডরের ১৮ বছর: মানুষের মনে এখনো শঙ্কার ছায়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০:৩৯, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
বগী গাবতলা এলাকায় বাঁধের বর্তমান অবস্থা। ছবি:: সংগৃহীত
আজকের এই দিনে ২০০৭ সালে বাংলাদেশের উপকূলীয় জনপদ শরণখোলায় আঘাত হেনেছিল প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় সিডর। ১৮ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই রাতের ভয় এখনও তাজা—শরণখোলার মানুষের মনে।
ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে শরণখোলা উপজেলা পরিণত হয়েছিল মৃত্যুপুরীতে। শুধু এই উপজেলাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন অন্তত ৯০৮ জন মানুষ। ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, আশ্রয়কেন্দ্র—সবই ধ্বংস হয়ে জীবনের গতিপথ বদলে দিয়েছিল সিডর।
আজ সকালে সাউথখালী ইউনিয়নের চালিতাবুনিয়া গ্রামের ভোরের দৃশ্য শান্ত। ধানখেত পেকে উঠেছে, মনোরম ছবি ফুটে উঠেছে প্রকৃতির ক্যানভাসে। কিন্তু শান্তির এই দৃশ্যের আড়ালে, গ্রামের মানুষদের মনে এখনও ভয়।
চালিতাবুনিয়ার বাসিন্দা দেলোয়ার তালুকদার (৪৪) সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ করে কাঁদেন। সিডরের রাতে পাঁচ বছরের ছেলে ও চার মাস বয়সী মেয়েকে হারিয়েছেন তিনি। দেলোয়ার বলেন, “সেদিন হালকা বৃষ্টি ছিল। রাত ৯টার দিকে হঠাৎ পানি বাড়তে শুরু করে। যখন আমার ছেলে এবং মেয়েকে রক্ষা করতে গেলাম, ঢেউ তাদের ভেসে নিয়ে গেল।”
দেলোয়ার আরও জানান, “সিডরের পরে যে বেড়িবাঁধ তৈরি হয়েছে, সেটা বালু দিয়ে বানানো। বারবার ভেঙে পড়ে। নদীর শাসন না হলে আতঙ্ক থাকবে। আমরা এখনো ভাঙা টিনের ঘরে থাকি। আগের জীবনে ফিরতে পারিনি।”
শাহজাহান মোল্লা (৫৫) বলেন, “জলোচ্ছ্বাস শুরু হলে আমরা নৌকায় আশ্রয় নিই। তারপরও পরিবারের পাঁচজনকে হারিয়েছি। এখনো আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে আছি। যে বাঁধ বানানো হয়েছে, তার অবস্থা ভালো নয়। নদীর তীর ঠিকভাবে সুরক্ষিত না হলে টিকে থাকা অসম্ভব।”
স্থানীয় সাংবাদিক শাহীন হাওলাদার বলেন, “সিডরের পর তৈরি বাঁধগুলোর আনুষ্ঠানিক হস্তান্তর হয়নি। কিন্তু বিভিন্ন জায়গায় ভেঙে গেছে। কঠোর নজরদারির মাধ্যমে সরকার টেকসই বাঁধ তৈরি না করলে ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হবে।”
বাগেরহাটের বগী বন্দর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। সিডরে বাবা-মা, সন্তান বা স্বজন হারানো মানুষরা এখন শুধু জীবনের নিরাপত্তা চায়। ক্ষতিপূরণ নয়, তাদের একমাত্র দাবি টেকসই বেড়িবাঁধ।
শরণখোলা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) মো. হাবিবুল্লাহ দ্য ডেইলি স্টারকে জানান, “টেকসই বাঁধ নির্মাণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা বলা হয়েছে। একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। ধাপে ধাপে বাঁধ নির্মাণের কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে। বিষয়টি আমার কাছে অত্যন্ত জরুরি।”
সিডরের ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু শরণখোলার মানুষের দুইটি আবেগই অটল—স্মৃতি এবং নিরাপত্তা চাওয়া। তারা চায়, বলেশ্বর নদী যেন আর কোনো প্রাণ কেড়ে না নেয়। যে জীবন, সংসার আর ভূমিকে নিয়ে তারা আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে, তা যেন সুরক্ষিত থাকে।
