টার্বুলেন্স বাড়ছে : এর সমাধানে কী করছে বিমান শিল্প?
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৪:৪৩, ২৮ জুলাই ২০২৫
সমাজকাল ডেস্ক
"আমরা ছাদের ওপর রক্ত দেখেছি... পুরোটা ছিল এক বিশৃঙ্খলা।"— ২০২৪ সালে মিয়ানমারের দক্ষিণাংশের আকাশে সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট তীব্র টার্বুলেন্সে পড়ার পর এক যাত্রীর অভিজ্ঞতা ছিল এমন। তিনি আরও বলেন, "অনেকেই মেঝেতে পড়ে গিয়েছিলেন।" এ বছরের শুরুতেও, ফিলিপাইনের আকাশে একটি ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের বোয়িং ৭৮৭ তীব্র টার্বুলেন্সে পড়ে। এতে এক কেবিন ক্রু ছিটকে ছাদে আঘাত পান এবং তার মস্তিষ্কে আঘাত ও হাত ভেঙে যায়।
মানবসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এমন টার্বুলেন্সের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। "ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স" বা অদৃশ্য টার্বুলেন্স, যা স্যাটেলাইট, রাডার কিংবা চোখে ধরা যায় না, ১৯৭৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫৫% বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ইউনিভার্সিটি অফ রিডিংয়ের অ্যাটমোসফিয়ারিক সায়েন্সের অধ্যাপক পল উইলিয়ামস।
বিশ্বজুড়ে টার্বুলেন্সের মাত্রা ২০৫০-এর মধ্যে তিনগুণ হতে পারে এবং এটি পূর্ব এশিয়া ও উত্তর আটলান্টিকের রুটগুলোতে মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। এতে করে মানুষের বিমানে ভ্রমণের আগ্রহ কমে যেতে পারে। অনেকে বিমান ভয় পোষণের অন্যতম কারণ হিসেবে নিয়ন্ত্রণ হারানো ও টার্বুলেন্সের অভিজ্ঞতাকেই দায়ী করেন।
টার্বুলেন্স কেবল যাত্রীদের অস্বস্তিই বাড়ায় না, বরং বিমান শিল্পের জন্য এটিতে আর্থিক ক্ষতির সম্ভাবনাও থাকে— বিমানের গায়ে অতিরিক্ত চাপ পড়ে, রুট পরিবর্তন করে উড়তে হয়, জ্বালানি বেশি খরচ হয়, যা আবার কার্বন নির্গমন বাড়ায়। যদিও টার্বুলেন্সে মৃত্যু বা গুরুতর আহতের ঘটনা বিরল, এর প্রাবল্য বাড়ায় এটিকে উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। ফলে এর সমাধানে চেষ্টা করছে গবেষক, প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিবিদেরা।
নতুন প্রযুক্তির খোঁজ
অস্ট্রিয়ার ব্যাডেনে অবস্থিত “Turbulence Solutions” নামের একটি কোম্পানি ছোট “ফ্ল্যাপলেট” তৈরি করেছে, যেগুলো বিমানের ডানার বড় ফ্ল্যাপে সংযুক্ত হয়ে থাকে। এই ফ্ল্যাপলেটগুলো ডানার সামনের অংশে চাপের পার্থক্য অনুযায়ী নিজেদের কৌণিক অবস্থান সামান্য পরিবর্তন করে এবং বিমানের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে। এটি অনেকটা পাখির পালক নাড়ানোর মতো।
কোম্পানিটি দাবি করছে, তাদের প্রযুক্তি যাত্রীদের অনুভূত টার্বুলেন্সের মাত্রা ৮০% পর্যন্ত কমিয়ে দিতে পারে। যদিও এটি এখনো কেবল ছোট বিমানে পরীক্ষিত, তবে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী আন্দ্রাস গালফি আশা করছেন এটি বড় বাণিজ্যিক বিমানে প্রয়োগ করা সম্ভব হবে।
গালফি বলেন, “সাধারণ ধারণা হলো টার্বুলেন্স থেকে বাঁচতে হলে হয় তা এড়িয়ে যেতে হবে বা তা মেনে নিতে হবে। আমরা বলছি, মেনে নেওয়ার দরকার নেই, সঠিক প্রতিসংকেত দিলেই প্রতিরোধ সম্ভব।”
এআই ও ফ্লুইড ডাইনামিক্স
টার্বুলেন্স মোকাবেলায় প্রয়োজন অত্যন্ত সূক্ষ্ম প্রকৌশল, জটিল গাণিতিক বিশ্লেষণ এবং তরল পদার্থের গতিবিদ্যার (fluid dynamics) সম্যক জ্ঞান। বাতাসও পানির মতো এক ধরনের তরল। যেহেতু টার্বুলেন্স মূলত এলোমেলো ও বিশৃঙ্খল আচরণের ফল, তাই সামান্য পরিবর্তনও অনেক বড় পার্থক্য তৈরি করতে পারে।
এই বিশৃঙ্খলা বুঝতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)। কেথ এইচ রয়্যাল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজির গবেষক রিকার্দো ভিনুয়েসা বলেন, “এআই উচ্চমাত্রার তথ্য বিশ্লেষণে অত্যন্ত দক্ষ। টার্বুলেন্স বিশ্লেষণে এটি আদর্শ হতে পারে।”
এক পরীক্ষায় ভিনুয়েসা ও তার সহযোগীরা বিমান ডানায় এআই দ্বারা নিয়ন্ত্রিত "সিন্থেটিক জেট" ব্যবহারের মাধ্যমে বাতাসের গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করেছেন। মডেলটি “ডিপ রিইনফোর্সমেন্ট লার্নিং” পদ্ধতিতে শিখেছে— যা শিশুদের হাঁটতে শেখার মতোই ধাপে ধাপে শেখার পদ্ধতি। এখানে এক্সপ্লেইনেবল এআই ব্যবহৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে বোঝা যায় কোন ডেটা সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে।
টার্বুলেন্স শনাক্তকরণ প্রযুক্তি
গত বছর, ক্যালটেক এবং এনভিডিয়া একটি উইন্ড টানেলে অত্যন্ত তীব্র টার্বুলেন্স তৈরি করে ড্রোনে এআই প্রযুক্তির পরীক্ষা চালায়। একই সময়ে নাসার ল্যাঙ্গলি রিসার্চ সেন্টারে এমন একটি মাইক্রোফোনের পরীক্ষা করা হয়েছে যা ৩০০ মাইল দূরের অদৃশ্য টার্বুলেন্সের ধ্বনি শনাক্ত করতে পারে।
একই সঙ্গে লিডার (Lidar) প্রযুক্তি নিয়েও গবেষণা চলছে। এটি বিমানের আশপাশের বাতাসের ত্রিমাত্রিক মানচিত্র তৈরি করতে পারে। ২০২৩ সালের একটি চীনা গবেষণায় বলা হয়েছে, "ডুয়াল-ওয়েভলেংথ" লিডার ব্যবহার করে ৭–১০ কিলোমিটার দূরের হালকা থেকে মাঝারি মাত্রার ক্লিয়ার-এয়ার টার্বুলেন্স শনাক্ত করা সম্ভব। তবে উচ্চতায় বাতাসের ঘনত্ব কম থাকায় এই যন্ত্রগুলো খুব ভারী ও বেশি শক্তি খরচকারী হয়, ফলে বর্তমানে তা বাণিজ্যিক বিমানে ব্যবহারযোগ্য নয়।
তথ্য সংগ্রহ ও অগ্রগতি
প্রতিদিন উড্ডয়ন করা প্রায় ১ লাখ বিমানের অ্যাক্সিলেরোমিটার এবং বিশ্বজুড়ে থাকা প্রায় ১,৩০০টি আবহাওয়া বেলুন থেকে সংগৃহীত তথ্যের ভিত্তিতে আমরা এখন বাতাসের অনেক তথ্য জানতে পারি।
বিশ্বব্যাপী রিয়েল-টাইম টার্বুলেন্স তথ্য ভাগাভাগির জন্য IATA চালু করেছে “Turbulence Aware” নামের একটি প্ল্যাটফর্ম, যা এয়ার ফ্রান্স, ইজি জেট এবং এর লিংগাসের মতো এয়ারলাইনগুলো ব্যবহার করছে। যাত্রীদের জন্য এমন কিছু অ্যাপও তৈরি হয়েছে, যার মাধ্যমে পাইলট ও ফ্লাইট ডিসপ্যাচারদের ডেটা দেখা যায়। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় অ্যাপ হলো Turbli।
পল উইলিয়ামস বলেন, “আমি Turbli ব্যবহার করি। এটি মোটামুটি নির্ভুল, যদিও যেহেতু আপনার সঠিক রুট জানা যায় না, ১০০% নির্ভুল নয়। তবে এটি কখনো কখনো হাইপোকন্ড্রিয়াকদের মতো আচরণ— বেশি জেনে অস্বস্তি বাড়িয়ে তোলে।”
তথ্য সূত্র : বিবিসি