ট্র্যাজেডির পর্দায় এক কাব্যময় জীবন
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৭:২৪, ১ আগস্ট ২০২৫

ট্র্যাজেডির পর্দায় এক কাব্যময় জীবন — ছোটবেলার দারিদ্র্য, প্রেমে ব্যর্থতা, পর্দায় অমর অভিনয় ও এক বিষণ্ন মৃত্যুর অশ্রুপাত। ‘সমাজকাল’-এ তাঁর জন্মদিনে শ্রদ্ধা।
সমাজকাল ডেস্ক
বলিউড ইতিহাসের সবচেয়ে বিষণ্নতম অথচ শৈল্পিক আত্মপ্রকাশের নাম যদি একটি বলা হয়— তা নিঃসন্দেহে মীনা কুমারী। হিন্দি সিনেমার 'ট্র্যাজেডি কুইন' শুধু অভিনয়ের মাধ্যমে নয়, তাঁর ব্যক্তিজীবনের ব্যথাও দর্শকদের মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। জন্ম, সংগ্রাম, সাফল্য, প্রেম ও পরিণতি— সব মিলিয়ে এক হৃদয়বিদারক কাব্য তাঁর জীবন।
শৈশবের শুরুতেই যন্ত্রণার ছায়া
মীনা কুমারীর জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ আগস্ট, ব্রিটিশ ভারতের বোম্বে শহরে। জন্মনাম ছিল মেহজাবিন বানু। বাবার নাম আলী বক্স, যিনি পার্সি থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন; মা ইকবাল বেগম— বিয়ের আগে প্রভাবতী দেবী নামে মঞ্চ অভিনেত্রী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জন্মের পরপরই দারিদ্র্যের কারণে তাকে একবার অনাথ আশ্রমে দিয়ে আসা হয়, তবে পরে বাবা-মা সিদ্ধান্ত বদলে তাঁকে ঘরে ফিরিয়ে আনেন। এ ছিল এক অনাকাঙ্ক্ষিত শিশুর গল্পের সূচনা।
সাত বছর বয়সে শুরু সিনেমা-যাত্রা
মাত্র সাত বছর বয়সে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন তিনি। ‘বেবি মীনা’ নামে ১৯৩৯ সালে ফারজানদ-এ-ওয়াতন ছবিতে অভিনয় করে যাত্রা শুরু হয়। ছোটবেলায় স্কুলে পড়াশোনার ইচ্ছা থাকলেও বাবার স্বপ্ন পূরণে তাঁকে স্টুডিওতে সময় দিতে হতো। প্রথমদিনের পারিশ্রমিক ছিল ২৫ টাকা। খুব শিগগিরই তিনি পরিবারে প্রধান উপার্জনকারী হয়ে ওঠেন।
নায়িকা হিসেবে উত্থান এবং ট্র্যাজেডির রাজত্ব
১৯৫২ সালে বেইজু বাওরা চলচ্চিত্র তাঁকে হিন্দি সিনেমার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে। এরপর একের পর এক কালজয়ী চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন— সাহিব বিবি অউর গুলাম, চিত্রলেখা, আরতি, কাজল, গজল, দিল এক মন্দির, চান্দনি চক, এবং সর্বোপরি পাকিজা।
এই সিনেমাগুলোয় তাঁর অভিনীত নারীচরিত্রগুলোর যন্ত্রণা, নিঃসঙ্গতা ও আত্মসমর্পণ যেন মীনা কুমারীর ব্যক্তিজীবনেরই প্রতিচ্ছবি। তিনি পর্দায় যে কান্না কেঁদেছেন, সেটি অভিনয়মাত্র ছিল না— অনেক সময় বাস্তব অনুভূতিরই বহিঃপ্রকাশ।
কমল আমরোহীর সঙ্গে প্রেম ও বিচ্ছেদ
চলচ্চিত্র পরিচালক কমল আমরোহীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ও বিবাহ ছিল বলিউডের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত অধ্যায়। তবে এই সম্পর্কও ছিল দ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও বিচ্ছেদে ভরা। ভালোবাসার নামে যে প্রতিশ্রুতি তিনি পেয়েছিলেন, তা পরিণত হয় এক বিষাদময় স্মৃতিতে। বিচ্ছেদের পর আরও বেশি নিঃসঙ্গ ও ভেঙে পড়েন মীনা কুমারী।
মদ, বিষণ্নতা ও এক নিঃসঙ্গ মৃত্যু
ব্যক্তিগত জীবনের অশান্তি, চলচ্চিত্রজগতের নিষ্ঠুরতা ও ভালোবাসাহীনতা মীনা কুমারীকে ঠেলে দেয় মদ্যপানে। তাঁর জীবন বিষণ্নতার প্রতীক হয়ে ওঠে। অতিরিক্ত মদ্যপানের ফলে লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে ৩১ মার্চ ১৯৭২ সালে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে মারা যান। মৃত্যুর সময় তাঁর হাসপাতালে বিল পর্যন্ত শোধ করার মত অর্থ ছিল না।
‘পাকিজা’ : মৃত্যুর আগমুহূর্তের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি
মৃত্যুর মাত্র তিন সপ্তাহ আগে মুক্তি পায় তাঁর জীবনের শ্রেষ্ঠ সিনেমা পাকিজা। এই সিনেমায় তাঁর প্রতিটি সংলাপ, প্রতিটি চোখের ভাষা যেন হয়ে ওঠে মীনা কুমারীর আত্মকথন। মৃত্যুর পর এই সিনেমা তাঁকে চিরকালীন করে তোলে।
একজন কবি ও আত্মজীবনীর শিল্পী
অভিনয়ের বাইরে মীনা কুমারী ছিলেন এক মননশীল কবি। উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর কবিতায় বিষাদ, প্রেম, নিঃসঙ্গতা ও আত্মপীড়ার ছাপ স্পষ্ট। তাঁর লেখা কাব্যগ্রন্থ নাজ এখনও সাহিত্যানুরাগীদের কাছে অনন্য সম্পদ।
পর্দার বেদনার রাজকন্যা
মীনা কুমারী ছিলেন একান্ত নিজের মতো একজন। তাঁর জীবনের প্রতিটি বাঁকে ছিল অসাধারণ প্রতিভার প্রকাশ এবং একইসঙ্গে এক গভীর ব্যক্তিগত বেদনার ছায়া। পর্দায় তিনি ছিলেন শক্তিশালী, অথচ বাস্তবজীবনে অব্যক্ত কান্নার এক নাম।
আজ ১ আগস্ট, তাঁর জন্মদিনে আমরা স্মরণ করি এক বিস্মৃত কাব্যিক জীবনের ট্র্যাজেডিকে— যে জীবনের প্রতিটি দৃশ্য ছিল সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয়, বেশি মানবিক।