ইতিহাসের এক অনন্য সংগীত-আবেদন : দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ
সমাজকাল
প্রকাশ: ১৩:৩৯, ১ আগস্ট ২০২৫

সমাজকাল ডেস্ক
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট। নিউ ইয়র্ক সিটির বিখ্যাত ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত হয় এক ঐতিহাসিক সংগীত অনুষ্ঠান—দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম সুসংগঠিত আন্তর্জাতিক চ্যারিটি কনসার্ট, যার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন শরণার্থী সংকটের জন্য অর্থ সংগ্রহ ও আন্তর্জাতিক সচেতনতা সৃষ্টি।
যখন বাংলাদেশের মানুষ এক রক্তাক্ত সংগ্রামের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে এবং কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, তখন বিশ্ববাসীর চোখ ছিল অন্যত্র। এই অবস্থায় সংগীত হয়ে উঠল এক নতুন বিপ্লবের ভাষা।
সংগীতের পর্দার আড়ালে: রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের বন্ধুত্ব
এই কনসার্টের উদ্যোক্তা ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং সাবেক বিটলস সদস্য জর্জ হ্যারিসন। রবিশঙ্কর হ্যারিসনকে জানালেন পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতন, গণহত্যা এবং শরণার্থী সংকটের ভয়াবহ বাস্তবতা। হ্যারিসন ছিলেন গভীরভাবে বিচলিত।
রবিশঙ্করের ভাষায়—
“George, this is the situation… I know it doesn’t concern you.”
হ্যারিসনের উত্তর ছিল:
“Yes, I think I’ll be able to do something.”
এই কথোপকথনের মধ্য থেকেই জন্ম নেয় ‘The Concert for Bangladesh’-এর ধারণা।
কনসার্টে অংশ নেওয়া কিংবদন্তিরা
মাত্র পাঁচ সপ্তাহের প্রস্তুতিতে হ্যারিসন তার বন্ধু ও সহশিল্পীদের একত্রিত করেন। পল ম্যাকার্টনি ও জন লেনন নানা কারণে আসতে না পারলেও বিটলসের আরেক সদস্য রিঙ্গো স্টার যোগ দেন। এছাড়াও ছিলেন:
বব ডিলান – তার প্রথম বড় পরিসরের লাইভ পারফর্মেন্স ১৯৬৯ সালের পর
? এরিক ক্ল্যাপটন
? বিলি প্রিস্টন
? লিয়ন রাসেল
? জিম কেল্টনার
?? ব্যাড ফিঙ্গার ব্যান্ড – রিদম গিটার ও ব্যাকআপ ভোকাল
? দ্য হলিউড হর্নস – জিম হর্ন ও অন্যান্যদের নিয়ে গঠিত
? কনসার্টের সংগীতানুষ্ঠান
রবিশঙ্কর, আলি আকবর খান, এবং ওস্তাদ আল্লা রাখা তবলায় পরিবেশন করেন ‘বাংলা ধুন’। তারপর শুরু হয় একের পর এক পশ্চিমা সংগীত পরিবেশনা, যার মধ্যে ছিলো:
While My Guitar Gently Weeps
Here Comes The Sun
A Hard Rain’s A-Gonna Fall
Just Like A Woman
My Sweet Lord
Bangla Desh (হ্যারিসনের লেখা এবং কনসার্টের প্রতীকী গান)
দুই দফা (বিকাল ও রাত) কনসার্টে গান ছিল মোট ১৮টির মতো।
অ্যালবাম ও তথ্যচিত্র
এই কনসার্ট শুধু সংগীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ১৯৭২ সালে Apple Films ও Columbia Records মিলিতভাবে একটি চলচ্চিত্র এবং তিন রেকর্ডের অ্যালবাম প্রকাশ করে। বব ডিলানের এটি ছিল তার প্রথম লাইভ রেকর্ড।
২০০৫ সালে পুনরায় প্রকাশিত হয় বিশেষ ডিভিডি সংকলন, যেখানে কনসার্টের সম্পূর্ণ চিত্র ও শিল্পীদের সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তথ্যচিত্রটির নাম ছিল:
The Concert for Bangladesh Revisited with George Harrison and Friends
সংগ্রহিত অর্থ ও বিতর্ক
প্রথম দফায় কনসার্ট থেকে প্রায় ২ লক্ষ ৪৩ হাজার ডলার সংগ্রহ করে ইউনিসেফ-এর মাধ্যমে শরণার্থীদের সাহায্য করা হয়। পরবর্তীতে অ্যালবাম, সিডি ও ডিভিডি বিক্রি থেকে মোট অর্থ প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যায়।
তবে আয়করের নিয়ম না মানার কারণে প্রায় ১১ বছর এই অর্থ মার্কিন অভ্যন্তরীণ রাজস্ব সংস্থার (IRS) অ্যাকাউন্টে আটকে ছিল। জটিল কাগজপত্র ও অ্যাপল কর্পোরেশনের অনীহার কারণে বিতরণে বিলম্ব হয়।
জন লেননের একটি মন্তব্য ছিল যথেষ্ট আলোচিত:
“সবসময়ই কিছু না কিছু চুরি হয়ে যায়… আমি বলতে পারবো না অর্থ কোথায় গেছে, এটা এখনো সমস্যা।”
সাংস্কৃতিক ও মানবিক প্রভাব
‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ শুধু একটি সংগীতানুষ্ঠান নয়—এটি মানবিকতার পক্ষে এক ঐতিহাসিক দাঁড়ানো ছিল। এটি বিশ্বজুড়ে চ্যারিটি কনসার্টের একটি নতুন ধারা তৈরি করে, যার রেশ পড়ে ‘Live Aid’, ‘Farm Aid’, ‘We Are The World’-এর মতো ভবিষ্যৎ উদ্যোগে।
জর্জ হ্যারিসনের সেই বিখ্যাত মন্তব্য আজও হৃদয় স্পর্শ করে:
“Because my friend asked me to help.”
১৯৭১ সালের আগস্টের সেই কনসার্ট ছিল এক সাংস্কৃতিক বিদ্রোহ—গানের সুরে, গিটার ও সেতারের ধ্বনিতে একটি মুক্তিকামী জাতির আহ্বান। 'বাংলাদেশ' শব্দটি সেদিন প্রথমবারের মতো বিশ্বসংগীতের মঞ্চে উচ্চারিত হয়েছিল গর্ব ও সহমর্মিতার সঙ্গে।