স্বাস্থ্যের ডিজির চেয়েও অস্বাস্থ্যকর অনেক সম্পাদক
প্রকাশ: ১৭:৫০, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
নিয়ন মতিয়ুল
বছর কয়েক আগে নববর্ষের কাছাকাছিতে পড়ল সাপ্তাহিক মিটিং। সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়ে সম্পাদক জানতে চাইলেন, নতুন বছরে কার কী পরিকল্পনা? একে একে সবাই বলতে লাগলেন। তবে ফ্লোর আসার আগেই সিনিয়র এক রিপোর্টার পাশের সহকর্মীর কানে কানে বলে বসলেন, নববর্ষে বেতনটা যদি বাড়ত! কানখাড়া করা সম্পাদক খপ করে কথাটা ধরেই গর্জে উঠলেন, “গেট আউট!...আউট!”
ঘটনার আকস্মিকতায় পিনপতন নীরবতা। রিপোর্টার মাথা নিচু করে বের হয়ে গেলেন। পরে জানা গেল, শুধু মিটিং থেকেই নয়, হাউজ থেকেও তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘটনা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম। কিছুদিন পর ঘটল আরেক কাণ্ড। চোখেমুখে টেনশন নিয়ে এক সহকর্মী বললেন, ভাই, বাবা ভীষণ অসুস্থ। বাড়ি যেতে হবে। ছুটি চাই। টিম লিডার হিসেবে বললাম, চলে যান। পরে এসে ছুটির দরখাস্ত দেবেন।
ঘণ্টাখানেক পর বিপদে পড়লাম। সম্পাদক জানতে চাইলেন, সে নেই কেন? কে ছুটি দিল তাকে? কোনো যুক্তির সুযোগ না দিয়েই ঝাড়ি মারলেন, হু আর ইউ? যে কয়দিন অনুপস্থিত থাকবে, বেতন কাটবেন। শুনে ঝিম ধরল মাথাটা। সহকর্মীদের প্রতি প্রায়ই এমন সদয় হওয়ার জন্য রটে গেল যে, আমি ভীষণ নরম। সহকর্মীদের বেশি বেশি ছাড় দিই। প্রশাসক হিসেবে কড়া নই।
বলে রাখা ভালো, সেই বিখ্যাত আর মহান সম্পাদক কিন্তু সংবাদকর্মীদের নিয়োগপত্র দিতেন না। ওয়েজবোর্ডের ফুল বেতনের স্বাক্ষর নিয়ে দিতেন এক তৃতীয়াংশ। অথচ বাগিয়ে নিতেন বিজ্ঞাপনের সর্বোচ্চ রেট। টকশোতে দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জাতিকে ধমকাধমকি করতেন। আমলাতন্ত্র, দুর্নীতি, অনিয়ম নিয়ে সরকারের মন্ত্রীদের বকতেন। অথচ, তার অফিসে প্রকাশ্যেই চলত বহুমুখী অনৈতিক, অস্বাস্থ্যকর সব কর্মকাণ্ড!
এমন অভিজ্ঞতা সংবাদমাধ্যমের প্রায় সব অফিসেরই। একবার এক তরুণ সম্পাদকের ডাকে নির্ধারিত সময়ে তার অফিসে গিয়ে দেখলাম তিনি বাইরে। বললেন, একটুখানি বসেন, দ্রুতই আসছি। সেই একটুখানি যে দেড় ঘণ্টা হবে তা ভাবতে পারিনি। অফিসে এসেই ‘তুমি’ সম্মোধন করলেন। প্রথম সাক্ষাতে আগে পিছে কিছু না ভেবেই ‘তুমি’ বলায় অবাক হলাম। পরে জেনেছি, তার ধমকাধমকিতে অনেকের হার্টে সমস্যা দেখা দেয়।
করোনাকালে এক বিশাল মাপের সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করার দুর্ভাগ্য হয়েছিল। দেখতাম, তিনি অফিসে এলেই সহকর্মীরা ভয় আর আতঙ্কে তটস্থ থাকতেন। সিরিয়াল ধরে ডেকে ডেকে ধমকাতেন। পান থেকে চুন খসলেই অফিস মাথায় তুলতেন। ক্ষোভ আর বিরক্তি নিয়ে মাস দেড়েকের মধ্যেই তার সঙ্গ ত্যাগ করেছিলাম। ভাবছিলাম, বিষয়টা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। বেশিরভাগ সম্পাদক বা সিনিয়ররা কেন জুনিয়র কর্মীদের সঙ্গে এমন বাজে আচরণ করেন? এর পেছনে সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কী কারণ থাকতে পারে?
স্বাস্থ্যের ডিজির “আপনি কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন” বক্তব্যের ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর সামাজিক মাধ্যমে অনেকেই নানা ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। একজন বিশেষজ্ঞ লিখেছেন, “বাংলাদেশে কর্মক্ষেত্রে হেনস্তা আর খারাপ ব্যবহার অনেকটা নরমাল হয়ে গেছে। বিশেষ করে টপ ম্যানেজমেন্টের অনেকেই মনে করেন, অন্য সবাই শুধুই অধস্তন, কিছু বোঝে না, শুধু চাপ আর ভয় দেখিয়ে কাজ করাতে হবে।”
আসলে মনে হয়, আমাদের জিন এখনও সামন্তযুগ, ঔপনিবেশিক আমল অতিক্রম করতে পারেনি। তাই, বসেরা নিজেদের ভাবেন রাজা আর অধস্তনদের দেখেন প্রজা হিসেবে। বিখ্যাত অনেক সম্পাদকের কাঁধে তাই ভর করে সামন্ত যুগের জিন। হাউজের কর্মীদের বেতন বৃদ্ধির দাবি শুনেই ‘গেট আউট’ বলে ধমক দেন।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
