মানুষের জন্য আগামী দিনের স্বপ্ন লাগে
প্রকাশ: ২১:০৩, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২২:৩৭, ৬ ডিসেম্বর ২০২৫
আজিজুর রহমান আসাদ
মার্ক্সবাদী/সাম্যবাদী, লিবারেল/সুশীল এবং মৌলবাদী–জঙ্গিবাদী বা জামাতি অবস্থান থেকে তিন ধরনের সমালোচনা রয়েছে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। এই তিন প্রকারের সমালোচনার শ্রেণিচরিত্র ও রাজনৈতিক মতাদর্শ আলাদা।
১. মার্ক্সবাদী/সাম্যবাদী অবস্থান থেকে সমালোচনার মূল ফোকাস শ্রেণিবৈষম্য, অর্থনৈতিক কাঠামো, দলের শ্রেণিচরিত্র। শ্রেণিবৈষম্যমূলক ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের ভূমিকা; নয়াউদারবাদী অর্থনীতি ও ক্রোনি ক্যাপিটালিজম, দলে পুঁজিবাদী ধনিকশ্রেণির আধিপত্য, করপোরেট/দুর্নীতিগ্রস্ত পুঁজিপতি গোষ্ঠীর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়।
আওয়ামী লীগের এই পুঁজিবাদী শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে অবস্থানের ফলে অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি ঘটে, অবকাঠামো উন্নয়ন হলেও সম্পদ মালিকানা ও বণ্টনে বৈষম্য বাড়ে। উন্নয়ন প্রকল্পগুলো ‘ধনিকশ্রেণি–উপযোগী’; যা স্বাভাবিকভাবেই সরকারের চরিত্র দমনমূলক করেছে, শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন ও বিরোধী কণ্ঠ দমনের মধ্য দিয়ে শ্রেণি স্বৈরাচারী ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে।
মার্ক্সবাদী/সাম্যবাদী সমালোচনার চরিত্র প্রধানত অর্থনৈতিক কাঠামো ও শ্রেণিস্বার্থের সংঘাত নিয়ে। এই সমালোচনার মতাদর্শগত ভিত্তি পুঁজিবাদ বিরোধিতা, শ্রেণিসংগ্রাম ও সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে।
২. লিবারেল/সুশীল (এবং এদের ইউরোপীয় মিত্রদের) সমালোচনার মূল ফোকাস হচ্ছে; গণতন্ত্র, মানবাধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা ইত্যাদি।
এদের সমালোচনার ভাষ্য হচ্ছে, গণতন্ত্রের সংকোচন, প্রতিযোগিতামূলক রাজনীতি দুর্বল হওয়া, একদলীয় প্রবণতা, নির্বাচনব্যবস্থা অকার্যকর করা, রাজনৈতিক অপরায়ন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ ইত্যাদি। এর ফলে যা হয়েছে তা মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, নির্যাতন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন/সাইবার আইনের অপব্যবহার, মিডিয়া স্বাধীনতা খর্ব, রাষ্ট্রক্ষমতার অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণ/এক ব্যক্তির হাতে, নির্বাহী ক্ষমতার একচেটিয়াকরণ, সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের দলীয়করণ ইত্যাদি।
এই সমালোচনার চরিত্র, প্রধানত লিবারেল (পশ্চিমা) গণতান্ত্রিক মানদণ্ড ও মানবাধিকার কেন্দ্রিক। এর মতাদর্শিক ভিত্তি লিবারেলিজম, আইনের শাসন, চেক অ্যান্ড ব্যাল্যান্স ইত্যাদি।
৩. মৌলবাদী–জঙ্গিবাদী/জামাতি রাজনৈতিক অবস্থান থেকে সমালোচনার মূল ফোকাস হচ্ছে, আওয়ামী লীগের নৈতিক স্খলন যা ইসলামপন্থা তথা শরিয়া আইনের বিরোধী।
এদের সমালোচনার মূলে আছে আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষতা/সেক্যুলার বাঙালি জাতীয়তাবাদের পক্ষে অবস্থান। এদের ভাষ্য হচ্ছে, আওয়ামী লীগ ১৯৭১–এর চেতনা নিয়ে ব্যবসা করে (নৈতিক স্খলন), সেক্যুলার প্রবণতা মানে ধর্মহীনতার পক্ষে, ভারতের দালাল, ‘ইসলামবিরোধী’ ফলে আওয়ামী লীগের দ্বারা জঙ্গিবাদ দমন, যুদ্ধাপরাধের বিচার ইত্যাদি শুধু ক্ষমতার জন্য। আওয়ামী লীগ যে সব লিবারেল কর্মসূচি নেয় (নারীনীতি প্রশ্নে) এগুলো ‘পশ্চিমা’, এবং ছহি ইসলামী নয়। এদের সমালোচনার ভাষা চরম ঘৃণা প্রকাশ, ব্যক্তি আক্রমণ, যেমন ফ্যাসিস্ট, খুনি, ভারতের দালাল—ইত্যাদি।
এদের আওয়ামী লীগ সমালোচনা প্রধানত সাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ‘মুসলিম’ পরিচয়, শরিয়াভিত্তিক রাজনীতি ও রাজনৈতিক ইসলামের প্রকল্প থেকে। মতাদর্শগত ভিত্তি হচ্ছে, সেক্যুলার রাষ্ট্রচিন্তার বিরোধিতা (ইসলামোফ্যাসিবাদ)।
দুঃখের বিষয় নানা ডিসকারসিভ কৌশলে, সামাজিক মাধ্যম ও সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে (এবং বামাতি সহায়তায়) জামাতিরা তাদের আওয়ামী লীগ বিরোধী ন্যারেটিভ মেইনস্ট্রিমে নিয়ে আসতে পেরেছে। আওয়ামী লীগ বিরোধী মার্ক্সবাদী ভাষ্য ও বিশ্লেষণ বহুল প্রচারিত না হওয়ায় অনেক বামকর্মীরাও জামাতি ভাষ্য মুখে ও অন্তরে তুলে নিয়েছে।
ইতিবাচক প্রগতিশীল রাজনীতি করতে হলে বৈষম্যমূলক পুঁজিবাদী ‘ব্যবস্থা’ বদলের রাজনীতিকে সামনে আনতে হবে; যা শুধু অন্য রাজনৈতিক দলকে সমালোচনা দিয়ে অর্জন করা যায় না। মানুষের জন্য আগামী দিনের স্বপ্ন লাগে, যা হবে জনগণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও সাম্যবাদের স্বপ্ন। মানুষে মানুষে ও নারী-পুরুষে সমতার ও সমৃদ্ধ জীবনের স্বপ্ন।
লেখক: গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
