বিএমইউয়ের গবেষণা রিপোর্ট
যথেচ্ছ ব্যবহারে অকার্যকর অনেক এন্টিবায়োটিক ওষুধ
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৮:৩১, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ‘এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স রিপোর্ট ২০২৪-২০২৫’। ছবি: বিএমইউ
দেশে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও ছত্রাকের বিরুদ্ধে এন্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহারের কারণে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন অ্যামোক্সিসিলিন, সেপট্রিয়াক্সজন জেনটাসমাইসিন, মেরোপেনেম, টিগেসাইসিলিনসহ বহু ওষুধ কাজ করছে না। অর্থাৎ রোগীর দেহে রেজিস্ট্যান্স হওয়ার কারণে এসকল অ্যান্টিবায়োটিক বা ওষুধ অকার্যকর হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএমইউ) ‘এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্স রিপোর্ট ২০২৪-২০২৫’- এ এই তথ্য উঠে এসেছে। গত এক বছরে বিএমইউয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগ বিভিন্ন রোগীর ৪৬ হাজার ২৭৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করে এই প্রতিবেদন তৈরি করে।
গবেষণায় বলা হয়, এন্টিবায়োটিক কাজ না করায় রোগীর রোগ নিরাময়কে দীর্ঘায়িত করছে। এমন কি রোগী সুস্থ হয়ে ওঠার পরিবর্তে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে।
চিকিৎসকরা জানান, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স হলো হলো যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক বা পরজীবীর মতো অণুজীবগুলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল ওষুধ (অ্যান্টিবায়োটিক, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিফাঙ্গাল ইত্যাদি) দ্বারা আর মারা যায় না বা তাদের বৃদ্ধি ব্যাহত হয় না। ফলে সংক্রমণ নিরাময় করা কঠিন হয়ে পড়ে। এটি বিশ্বব্যাপী জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি মারাত্মক হুমকি এবং চিকিৎসা পদ্ধতিকে ব্যাহত করছে।
এটি মূলত ওষুধের ভুল ব্যবহার বা অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে ঘটে। এ কারণে অণুজীবগুলো নিজেদের পরিবর্তন করে ওষুধ প্রতিরোধী হয়ে ওঠে এবং সাধারণ সংক্রমণও প্রাণঘাতী হতে পারে।
সোমবার (৮ ডিসেম্বর) বিএমইউতে বিশ্ব অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল সচেতনতা সপ্তাহ ২০২৫ উপলক্ষে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। ‘এখনই পদক্ষেপ নিন, আমাদের বর্তমানকে রক্ষা করুন, আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষিত করুন’ এই স্লোগান নিয়ে বিএমইউয়ের মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগ এই সচেতনতা সপ্তাহ উদযাপন করে।
গবেষণায় বলা হয়, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) এর ক্রমবর্ধমান হুমকি মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধি, এ্যান্টিবায়োটিকের যুক্তিসংগত ব্যবহার, সংক্রমণ প্রতিরোধ, এবং স্বাস্থ্যসেবার ভবিষ্যৎ রক্ষায় কমিউনিটির সম্পৃক্ততা বাড়ানোই এ আয়োজনের মূল উদ্দেশ্য।
সতর্ক করলেন বক্তারা
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বিএমইউ উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম। সভাপতিত্ব করেন মাইক্রোবায়োলজি এন্ড ইমিউনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার।
অনুষ্ঠানে ভিডিও বার্তায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান বলেন, এক সময় মানুষ ব্যাকটেরিয়ার কাছে পরাস্ত হতো। কারণ তখন তাদের হাতে ব্যাকটেরিয়াকে প্রতিরোধ করার মতো পর্যাপ্ত ওষুধ ছিল না। আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মানবজাতি আবার সেই একই সংকটে পড়তে পারে। তবে এইবার ওষুধ থাকবে, কিন্তু সেগুলো ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে কার্যকর হবে না। তাই অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্সকে এখন বিশ্বব্যাপী ‘এক মহা বিপর্যয়’ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
অনুষ্ঠানে অধ্যাপক ডা. মো. শাহিনুল আলম বলেন, সমস্যার দায় ও সমাধানের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিতে হবে। এ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এর ক্ষেত্রে গবেষণা, গাইডলাইন প্রণয়ন, বাস্তবায়নে মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বিএমইউকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
এ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এর চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলা করা অসম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে যেগুলো সমাধান যোগ্য নয় তারও উপায় খুঁজে বের করার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই দায়িত্ব পালন করে জাতিকে মানুষকে আশার আলো দেখাতে হবে।
উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. মোঃ আবুল কালাম আজাদ বলেন, এ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স ভয়াবহ ধারণ করেছে। জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত এই সমস্যা মোকাবিলায় সকলকেই দেরি না করে এখনই প্রয়োজনীয় উদ্যোগ ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার বলেন, অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (এএমআর) বর্তমানে বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের সবচেয়ে বড় হুমকিগুলোর একটি। অযথা অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, নিজে নিজে ওষুধ খাওয়া, অসম্পূর্ণ ডোজ, এবং প্রাণিসম্পদে অ্যান্টিবায়োটিকের অতিরিক্ত ব্যবহার- এসব কারণে জীবাণুগুলো ধীরে ধীরে ওষুধের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী হয়ে উঠছে।
তিনি আরও বলেন, এএমআর এর ফলে যে রোগ আগে সহজে ভালো হয়ে যেত, এখন সেই রোগও চিকিৎসা করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ সংক্রমণ জটিল হয়ে যায়, চিকিৎসার খরচ বেড়ে যায়, আইসিইউ ভর্তি থেকে শুরু করে মৃত্যু- সবই বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের কারণে।
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার পরামর্শ দিয়ে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিক সচেতনভাবে ব্যবহার করতে হবে। নিজের নয়, ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনেই ওষুধ নিতে হবে। হাত ধোয়া, টিকাদান, নিরাপদ খাদ্য, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং সঠিক সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ- অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স প্রতিরোধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা সবাই যদি দায়িত্বশীল হই, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি নিরাপদ স্বাস্থ্যব্যবস্থা উপহার দিতে পারবো।
মত দেন যারা
অনুষ্ঠানে মতামত দেন বিএমইউ ডিন অধ্যাপক ডা. মোঃ ইব্রাহীম সিদ্দিক, অধ্যাপক ডা. মোঃ আতিয়ার রহমান ও ডা. সাখাওয়াত হোসেন সায়ন্ত, নবজাতক বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নান, শিশু হেমাটোলজি অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আনোয়ারুল করিম, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আয়েশা খাতুন, গাইনোকোলজিক্যাল অনকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জান্নতুল ফেরদৌস, ল্যাবরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সাইফুল ইসলাম, বায়োকেমিস্ট্রি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নায়লা আতিক খান, ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. ইলোরা শারমিন, পরিচালক হাসপাতাল ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইরতেকা রহমান, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার, সহযোগী অধ্যাপক ডা. চন্দন কুমার রায়, জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. ফারজানা ইসলাম প্রমুখ।
প্রতিবেদনের মূল পরিসংখ্যান ও বৈজ্ঞানিক ফলাফল তুলে ধরেন মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শাহেদা আনোয়ার ।
রিপোর্টে বলা হয়, নিয়মিত প্রশিক্ষণ, মনিটরিং, ইকিউএএস অংশগ্রহণ ও কঠোর ইন্টারনাল কোয়ালিটি কন্ট্রোলের মাধ্যমে ডেটার গুণগত মান বজায় রাখা হয়েছে।
কোন ওষুধ কতটুকু কার্যকর
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২৪-২৫ সালে বিএমইউ–তে মোট ৪৬ হাজার ২৭৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করা হয়। এর মধ্যে ১১ হাজার ১০৮টি (২৪ শতাংশ) কালচর পজিটিভ। প্রস্রাবের নমুনা সর্বাধিক, এরপর রক্ত।
প্রস্রাবে প্রধান প্যাথোজেন ই.কোলি এবং রক্তে স্যালমোনেলা টাইফি সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। রক্তে স্যালমোনেলা টাইফি’তে সিপ্রোফ্লোক্সাসিন এর রেজিস্ট্যান্স সর্বোচ্চ। তবে ক্লোরামফেনিকো ও ট্রাইমেথোপ্রিম-সালফামেথোক্সাজোল এর বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স তুলনামূলক কম।
কয়েকটি আইসোলেট ceftriaxone এর প্রতিও রেজিস্ট্যান্ট, যা ক্লোনালিটি বোঝার জন্য জেনেটিক সিকোয়েন্সিংয়ের প্রয়োজনীয়তা নির্দেশ করে।
E. coli তে ciprofloxacin ও অ্যামোক্সিসিলিন (amoxicillin) রেজিস্ট্যান্স উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, যদিও meropenem ও tigecycline এখনো কার্যকর।
নিউমোনিয়া ও মূলনালীর সংক্রমণজনিত ব্যাক্টেরিয়া ক্লেবসিয়েলা’তে সেপট্রিয়াক্সজন, জেনটাসমাইসিন ও ciprofloxacin এর রেজিস্ট্যান্স মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রায়।
colistin ও tigecycline এখনো কার্যকর হলেও রেজিস্ট্যান্সের প্রবণতা বাড়ছে।
Acinetobacter spp.–এ প্রায় সব প্রচলিত এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে উচ্চমাত্রার রেজিস্ট্যান্স, এমনকি মেরোপেনেম (meropenem) ও টিগেসাইসিলিন (tigecycline)–এও রেজিস্ট্যান্সের উর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, বিশেষত হাসপাতাল অর্জিত সংক্রমণে।
২০২২ থেকে ২০২৫ ট্রেন্ড বিশ্লেষণে এমআরএসএ ও প্রস্রাবের ইএসবিএল উৎপাদক E. coli কিছুটা কমলেও carbapenemase-producing E. coli, Klebsiella, Acinetobacter এবং Pseudomonas এ কার্বাপেনেম রেজিস্ট্যান্স উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
আইসিইউ কেন্দ্রিক ইনভেসিভ ক্যান্ডিডেমিয়ায় Candida tropicalis ও Candida albicans সবচেয়ে বেশি পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন প্রজাতিতে fluconazole রেজিস্ট্যান্স উল্লেখযোগ্য, বিশেষ করে C. ciferrii, C. albicans, C. parapsilosis, C. guilliermondii, C. tropicalis-এ।
এই প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করতে অবদান রেখেছেন বিএমইউ মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিউনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আবু নাসের ইবনে সাত্তার, ডা. চন্দন কুমার রায়, ডা. শাহেদা আনোয়ার, ডা. সানজিদা খন্দকার সেতু, ডা. ইসমেত নিগার, ডা. রেহানা রাজ্জাক খান এবং ডা. এস. এম. আলী আহমেদ প্রমুখ।
এছাড়া ডেটা সংগ্রহ, ল্যাবরেটরি বিশ্লেষণ ও সংকলনে মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের এমডি রেসিডেন্ট ডাক্তার এবং ল্যাব টেকনোলজিস্টগণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং তারা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন ।
অনুষ্ঠানে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এর উপর তৈরি পোস্টার প্রেজেনটেশন ইভেন্টে বিজয়ী চিকিৎসকদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করা হয়।
