দুর্গম পাহাড়ে তরুণ মারমার স্বপ্নের স্কুল
প্রজন্ম ডেস্ক, সমাজকাল
প্রকাশ: ১২:৩৯, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

পাহাড়ের কোলে যখন ভোরের সূর্য আলো ছড়িয়ে দেয়, তখন পোপা বদলাপাড়ার ছোট্ট শিশুরা খালি পায়ে হাঁটতে শুরু করে তাদের নতুন স্কুলের পথে। চারদিকে পাহাড়ি গাছ, বাতাসে গাছের পাতার ফিসফিস আওয়াজ, আর আঁকাবাঁকা পথ। সেই পথ ধরে এগিয়ে চলে এক তরুণের স্বপ্নের স্কুলের ছোট্র শিক্ষার্থীরা।
বান্দরবানের লামা উপজেলা সদর থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে পোপা বদলাপাড়া। বিদ্যুৎ নেই, সুপেয় পানি নেই, হাসপাতাল নেই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও ছিল না। স্বাধীনতার এত বছর পর অবশেষে ২০২৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এখানে যাত্রা শুরু করে পোপা বদলা আশা-হোফনুং আনন্দময়ী বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিদ্যালয়ের পেছনে আছেন এক তরুণ শিক্ষক, নীরব যোদ্ধা ও স্বপ্নদ্রষ্টা উথোয়াইয়ই মারমা।
উথোয়াইয়ইয়ের জন্ম বান্দরবানের গজালিয়া ইউনিয়নের গাইন্দ্যাপাড়ায়। দারিদ্র্য ছিল তার নিত্যসঙ্গী। এক স্কুল থেকে আরেক স্কুলে, নানা বাধা পেরিয়ে শিক্ষাজীবন ছিল কঠিন। ২০০৯ সালে এসএসসি, ২০১১ সালে এইচএসসি এবং পরবর্তীতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করেন। ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার। সেই স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয় ২০১২ সালে, যখন তিনি থানচির হালিরামপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। পরে বদলি হয়ে লামার চেয়ারম্যানপাড়ায় ফিরে আসেন। কিন্তু স্বপ্নের পথচলা থেমে থাকেনি।
ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছবি তোলা আর ভিডিও করার প্রতি আগ্রহী ছিলেন। সুযোগ পেলেই ছুটে যেতেন দুর্গম পাহাড়ে, মানুষের জীবনযাত্রা, প্রকৃতির রূপ আর পাহাড়ি বাস্তবতা ধরে রাখতেন ক্যামেরায়। এসব ছবি আর ভিডিও তিনি নিয়মিত প্রকাশ করতেন সামাজিক মাধ্যমে। ২০১৫ সালে তিনি ‘উথোয়াই ভয়েজার’ নামে একটি ফেসবুক পেজ চালু করেন, যা থেকে শুরু হয় পাহাড়ের গল্প শোনানোর এক নতুন যাত্রা।
শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার মূল উদ্যোগ শুরু হয় ২০১৬ সালে। শাহরিয়ার পারভেজসহ কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবীর প্রচেষ্টায় গজালিয়ার এক মুরং পাড়ায় তৈরি হয় একটি মাচাং ঘরের স্কুল। উথোয়াইয়ই সেই উদ্যোগে যুক্ত হয়ে একে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দেন। নাম রাখেন ‘পাওমুম থারক্লা’, অর্থাৎ কলি থেকে ফোটা ফুল। এখান থেকেই নতুন এক যাত্রা শুরু হয়।
পরবর্তী সময়ে একে একে আরও তিনটি বিদ্যালয় গড়ে ওঠে। ২০২১ সালে সরই ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত হয় চেননৈ বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০২২ সালে নাইক্ষ্যংছড়ির রেংয়নপাড়ায় গড়ে ওঠে আশা-হোফনুং বিদ্যালয়। সর্বশেষ ২০২৪ সালে যাত্রা শুরু করে পোপা বদলা আশা-হোফনুং আনন্দময়ী বিদ্যালয়। প্রতিটি বিদ্যালয়ই একেকটি দুর্গম অঞ্চলের শিশুদের জন্য আশার আলো।
বিদ্যালয়গুলো চলে স্থানীয় সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাশ্রমে। অভিভাবকরা প্রতিমাসে মাত্র দুই শত টাকা দিয়ে থাকেন। গ্রাম প্রধানরা বিদ্যালয়ের নামে জমি দান করেন, সেখানে গড়ে ওঠে বাগান। সেই বাগানের ফল ও বাঁশ বিক্রি করেই চলে বিদ্যালয়ের ব্যয়ভার।
বর্তমানে গজালিয়ার কালোপাড়ায় আরেকটি বিদ্যালয় নির্মাণের প্রস্তুতি চলছে। এর নাম হবে ‘সাইরাও থারবা’। উথোয়াইয়ইয়ের ভাষায়, তিনি শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত শিশুদের মুখে হাসি দেখতে চান। পাহাড়ের শিশুদের চোখেমুখে তিনি খুঁজে পান নতুন সম্ভাবনার বাংলাদেশ। তার এই পথচলায় একের পর এক জেগে উঠছে নতুন প্রজন্মের স্বপ্ন, আর পাহাড়ের নির্জনতায় ফুটে উঠছে শিক্ষার দীপ্ত আলো।