মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীনতার অগ্নিপুরুষ”
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১২:৫৭, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক ও স্বাধীনতার অগ্নিপুরুষ”,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে যদি কোনো এক ব্যক্তির নাম সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়, তিনি হলেন জেনারেল মহম্মদ আতাউল গণি ওসমানী—যিনি বঙ্গবীর উপাধিতে অভিষিক্ত। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক হিসেবে তার নেতৃত্ব শুধু সামরিক বিজয়ই নিশ্চিত করেনি, বরং এক স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে। তার অদম্য সাহস, বুদ্ধিমত্তা ও দৃঢ় সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পথে এগিয়ে নিয়েছিল।
শৈশব ও পারিবারিক পটভূমি
ওসমানীর জন্ম ১৯১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর সুনামগঞ্জ শহরে। তাদের পৈত্রিক বাড়ি সিলেট জেলার দয়ামীর গ্রামে। তার বাবা খান বাহাদুর মফিজুর রহমান ছিলেন ব্রিটিশ আমলের একজন সরকারি কর্মকর্তা, মা ছিলেন জোবেদা খাতুন। পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই তিনি পরিবারের স্নেহে বেড়ে ওঠেন। পিতার বদলির কারণে শৈশব কেটেছে সুনামগঞ্জ, গোহাটি ও সিলেটসহ বিভিন্ন স্থানে।
শিক্ষা জীবনে অনন্য কৃতিত্ব
১৯৩৪ সালে সিলেট গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় সমগ্র ব্রিটিশ ভারতে প্রথম স্থান অধিকার করেন—যা ছিল অভূতপূর্ব কৃতিত্ব। এজন্য ব্রিটিশ সরকার তাকে “প্রাইওটোরিয়া পুরস্কার” প্রদান করে। পরে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩৮ সালে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। এই অসাধারণ শিক্ষাজীবনই তাঁর শৃঙ্খলাবোধ ও নেতৃত্বগুণের ভিত্তি গড়ে দেয়।
ব্রিটিশ সেনাবাহিনী থেকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী
১৯৩৯ সালে দেরাদুনের ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে যোগ দেন তিনি। ১৯৪০ সালে কমিশন লাভ করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। অল্প বয়সেই মেজর পদে উন্নীত হওয়া তাঁকে আলোচনায় আনে।
দেশভাগের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তিনি “ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট”-এর প্রথম বাঙালি অধিনায়ক হন। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাস প্রতিষ্ঠা করেন এবং সেনাবাহিনীতে দক্ষ কৌশলী অফিসার হিসেবে পরিচিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব
১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাদের দমননীতি এবং গণহত্যা শুরু হলে ওসমানী সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নেন। ১০ এপ্রিল গঠিত অস্থায়ী মুজিবনগর সরকার তাঁকে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেয়।
তার প্রধান অবদানগুলো ছিল:
সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা এবং দক্ষ সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের সমন্বয়।
গেরিলা যুদ্ধ কৌশল চালু করে পাকিস্তানি সেনাদের ছাউনিতে আটকে রাখা।
বিশেষ নৌ-কমান্ডো বাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক বিমান ইউনিট গঠন।
তার নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ধীরে ধীরে শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভারতের সেনাদের সাথে যৌথভাবে আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়।
স্বাধীনতার পর সেনাপ্রধান
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাকে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম সেনাপ্রধান এবং দেশের প্রথম চার তারকা জেনারেল করা হয়। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে তিনি সেনাপ্রধানের দায়িত্ব ছেড়ে মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেন।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে ডাক, তার, টেলিযোগাযোগ ও নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেন।
তবে একদলীয় বাকশাল ব্যবস্থার বিরোধিতা করে তিনি আওয়ামী লীগ ও সংসদীয় পদ ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে জাতীয় জনতা পার্টি গঠন করে দু’বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ নেন।
মৃত্যু ও উত্তরাধিকার
ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৮৪ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি লন্ডনে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তাঁকে পূর্ণ সামরিক মর্যাদায় সিলেটের শাহজালাল মাজার প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ঢাকা ও সিলেটে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওসমানী উদ্যান, ওসমানী মেডিকেল কলেজ, ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এবং ওসমানী মেমোরিয়াল হল। বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করে।
জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী শুধু একজন সেনাপ্রধান ছিলেন না, তিনি ছিলেন স্বাধীনতার স্বপ্নের রূপকার। তাঁর রণকৌশল, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেম ছাড়া হয়তো মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য সহজে আসত না। আজকের বাংলাদেশ তাঁর অমর অবদানের কাছে চিরঋণী।