বৃহস্পতিবার, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

| ১৪ কার্তিক ১৪৩২

প্রতিদিন বাড়ছে ইলেকট্রিক বাহন, বদলে যাচ্ছে ঢাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৮:১৫, ৩০ অক্টোবর ২০২৫

প্রতিদিন বাড়ছে ইলেকট্রিক বাহন, বদলে যাচ্ছে ঢাকা

রাজধানী ঢাকায় এখন নীরবে ঘটছে এক প্রযুক্তিগত রূপান্তর। রাস্তায় কমে যাচ্ছে ধোঁয়াচালিত গাড়ির গর্জন, তার জায়গা নিচ্ছে নিঃশব্দে ছুটে চলা ব্যাটারি চালিত বাহন। চীনের তৈরি ই-বাইক, ইজিবাইক ও ইলেকট্রিক কার এখন ঢাকার অলিগলি থেকে মহাসড়ক পর্যন্ত দাপট দেখাচ্ছে। যেন অজান্তেই বদলে যাচ্ছে শহরের যানচিত্র।

এক সময় সিএনজি ও মোটরসাইকেল ছিল নগরবাসীর প্রধান যাতায়াত মাধ্যম। কিন্তু তেলের দাম বৃদ্ধি, যানজট এবং দূষণ—এই তিন কারণে মানুষ বিকল্প খুঁজতে শুরু করেছে। সেই শূন্যস্থান পূরণ করছে ইলেকট্রিক বাহন। এই যানগুলো একদিকে খরচে সাশ্রয়ী, অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব। ফলে দিন দিন এদের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।

গুলিস্তান, মিরপুর, বনানী, উত্তরা—প্রায় প্রতিটি এলাকায় এখন ব্যাটারি চালিত ছোট-বড় বাহন দেখা যায়। অফিসগামী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রী—সবাই ধীরে ধীরে এই নতুন চলাচল ব্যবস্থায় অভ্যস্ত হয়ে উঠছেন। এক যাত্রী হাসান মাহমুদ বলেন, 'আগে অফিসে যেতে মোটরসাইকেলে প্রতিদিন ২০০ টাকার মতো খরচ হতো, এখন ই-বাইকে তা অর্ধেকেরও কম। আর শব্দ নেই, ধোঁয়া নেই—শান্তিতে যাতায়াত করা যায়।'

এই পরিবর্তনের ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি রয়েছে উদ্বেগও। পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক জিয়াউল হক বলেন, 'ইলেকট্রিক বাহনের ব্যবহার শহরের বায়ুদূষণ ও শব্দ দূষণ কমাতে সাহায্য করছে। কিন্তু ব্যাটারির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে এখনো কোনো কার্যকর নীতি হয়নি। ভবিষ্যতে এটি পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হতে পারে।' 

চীনের একাধিক কোম্পানি ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের বাজারে নিজেদের অবস্থান শক্ত করছে। কয়েকটি ব্র্যান্ডের ইজিবাইক ঢাকার রাস্তায় দেখা যাচ্ছে। এই কোম্পানিগুলোর স্থানীয় প্রতিনিধি সংস্থাগুলো বলছে, বাজারে চাহিদা বাড়ার কারণে বিক্রি গত দুই বছরে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। কম দামে আধুনিক প্রযুক্তি ও সহজ চার্জিং সুবিধা পাওয়ায় অনেকেই চীনা ইলেকট্রিক বাহন বেছে নিচ্ছেন।

ইলেকট্রিক যানবাহনের এই জনপ্রিয়তা বাড়লেও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। চার্জিং স্টেশন অপ্রতুল, ফলে অনেক সময় চালকদের অসুবিধায় পড়তে হয়। অনেকেই নিজের বাসায় চার্জ দিয়ে গাড়ি চালান, যা বিদ্যুতের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি করছে। তবুও এর সহজলভ্যতা ও কম রক্ষণাবেক্ষণ খরচের কারণে ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

অন্যদিকে, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দিক থেকেও নতুন সংকট তৈরি হচ্ছে। ই-বাইক ও ইজিবাইক চালকরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ ছাড়াই রাস্তায় নামছেন। সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, এখনো ইলেকট্রিক যানবাহনের জন্য কোনো আলাদা নিবন্ধন বা নিয়ন্ত্রণনীতি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও বাড়ছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শহরের উন্নয়ন পরিকল্পনায় এখনই ইলেকট্রিক যানবাহনকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। নয়তো যেভাবে রাস্তায় এসব বাহনের সংখ্যা বাড়ছে, তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এক ট্রাফিক কর্মকর্তা বলেন, 'ই-বাহনের জন্য আলাদা লেন ও নিবন্ধন ব্যবস্থা না থাকলে ভবিষ্যতে এটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।'

তবুও অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, ইলেকট্রিক বাহনের এই রূপান্তর বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক ইঙ্গিত। সঠিক নীতি, ব্যাটারি পুনঃব্যবহার ব্যবস্থা এবং পরিবহন পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে এটি হতে পারে টেকসই নগর পরিবহনের এক নতুন অধ্যায়।

পরিবেশবিদ রাশেদা খাতুন বলেন, 'ঢাকার বায়ু যে ধীরে ধীরে একটু পরিষ্কার হচ্ছে, তার পেছনে ইলেকট্রিক বাহনের অবদান অস্বীকার করা যাবে না। তবে ব্যাটারি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিলে এই অর্জন অল্প সময়েই হারিয়ে যাবে।'

বর্তমানে রাজধানীতে যে পরিবর্তন ঘটছে, তা কেবল প্রযুক্তিগত নয়, জীবনযাত্রারও পরিবর্তন। মানুষ এখন আর আগের মতো তেলচালিত ইঞ্জিনের গর্জন চায় না—চায় শান্ত, পরিচ্ছন্ন চলাচল। চীনের ইলেকট্রিক বাহন সে চাহিদা পূরণের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে।

তবে এই অগ্রগতির সঙ্গে দায়িত্বও বাড়ছে। নীতিনির্ধারক, ব্যবসায়ী ও নাগরিক—সবাইকে এখনই ভাবতে হবে কীভাবে এই পরিবর্তনকে নিরাপদ ও স্থায়ী করা যায়। অন্যথায়, ইলেকট্রিক বাহনের এই নীরব বিপ্লব একদিন হয়তো নিজেই নতুন দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

সম্পর্কিত বিষয়:

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন