ইসরায়েলি কারাগারে বন্দিদের ওপর মধ্যযুগীয় নির্যাতন চলেছে
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭:০৬, ২৩ অক্টোবর ২০২৫

ইসরায়েলের কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ফিলিস্তিনি বন্দিরা। ছবি: সংগৃহীত
গাজা যুদ্ধের আবহে ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর ইসরায়েলের কারাগারে যে অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা যেন মধ্যযুগের নির্যাতনের ভয়াল স্মৃতি জাগিয়ে তুলেছে। মানবাধিকার সংস্থা ও জাতিসংঘের অভিযোগ—বিচারহীনভাবে হাজারো গাজাবাসীকে আটক করে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে বছরের পর বছর মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হয়েছে।
হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতির চুক্তির অংশ হিসেবে সম্প্রতি ২৫০ জন দণ্ডিত বন্দি ও প্রায় ১ হাজার ৭০০ আটক গাজাবাসীকে মুক্তি দিয়েছে ইসরায়েল। এদের অধিকাংশের বিরুদ্ধেই কোনো আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ছিল না, আদালতে তোলাও হয়নি। তাদের মাসের পর মাস নিঃসঙ্গ অবস্থায় আটক রাখা হয়—যেখানে আলো, বিশ্রাম বা বাইরের জগতের সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সুযোগই ছিল না।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ‘যোদ্ধাদের আটক আইন’-এর আওতায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনী (আইডিএফ) ও গোয়েন্দা সংস্থা শিন বেত বিপুলসংখ্যক গাজাবাসীকে আটক করে। অনেককেই হাসপাতাল, স্কুল বা আশ্রয়কেন্দ্র থেকে ধরে নেওয়া হয়। জাতিসংঘের ২০২৪ সালের প্রতিবেদনে বলা হয়, “আবাসিক এলাকা ও রাস্তার চেকপয়েন্টে সাধারণ মানুষকেও নির্বিচারে আটক করা হয়েছে।”
২০২৫ সালের অক্টোবরের শুরুতে ‘অবৈধ যোদ্ধা’ আইন অনুযায়ী বন্দির সংখ্যা ছিল প্রায় ২,৬৭৩ জন। মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ জানিয়েছে, আটকাদেশ সাধারণত ছয় মাসের হয়, যা বিচার ছাড়াই নবায়ন করা হয় ভিডিও কনফারেন্সে কয়েক মিনিটের শুনানিতে।
বন্দিদের অধিকাংশই জানতেন না, কেন তাদের আটক করা হয়েছে। তাদের আইনজীবী নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়নি, এমনকি আন্তর্জাতিক রেড ক্রসও দেখা করতে পারেনি। পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগও ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ।
মুক্তিপ্রাপ্ত অনেক বন্দি জানিয়েছেন—কারাগারে নিয়মিত মারধর, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব এবং ঘুম বঞ্চনার মতো নির্যাতন চলেছে।
একজন ২৩ বছর বয়সী ট্রাকচালক জানান, “আমাকে ‘ডিস্কো রুমে’ নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা উচ্চ শব্দে গান শুনিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হতো। ঘুমাতে দেওয়া হতো না।”
আরেকজন বন্দি জানান, খান ইউনুস থেকে তাকে চোখ বেঁধে ও হাতকড়া পরিয়ে ৯৬ দিন আটক রাখা হয়েছিল। বাথরুমেও হাতকড়া খোলা হয়নি।
মানবাধিকার সংগঠন হামোকেদ অন্তত ১২ জন বন্দির কাছ থেকে নির্যাতনের প্রমাণ পেয়েছে। সংগঠনের নির্বাহী পরিচালক জেসিকা মন্টেল বলেন, “আমরা কেবল ৫০ জন বন্দির আইনজীবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ নিশ্চিত করতে পেরেছি—এটাই ইসরায়েলি আটক নীতির নিষ্ঠুরতার প্রমাণ।”
ইসরায়েলি সেনা ও কারা কর্তৃপক্ষ নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করলেও ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক রিজার্ভ সেনাকে বন্দিদের ওপর নির্যাতনের দায়ে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। একই মাসে আরও পাঁচ সেনার বিরুদ্ধে একজন ফিলিস্তিনি বন্দিকে নির্যাতনের মামলা চলে।
ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির প্রকাশ্যে স্বীকার করেন, “ফিলিস্তিনি বন্দিদের ওপর কঠোর নীতি প্রয়োগ করা হয়েছে।”
গাজার যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই আন্তর্জাতিক মহল ইসরায়েলের আচরণের তীব্র সমালোচনা করছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন জানিয়েছে—এই ধরনের আটক ও নির্যাতন আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের সামিল এবং তা ‘যুদ্ধাপরাধ’ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।