শুক্রবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

| ১১ আশ্বিন ১৪৩২

ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

বিশেষ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ২০:৩২, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০০:৫৭, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ওয়াংচুকের নেতৃত্বে লাদাখে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা

ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লাদাখে এক ভয়াবহ বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে নতুন এক রাজনৈতিক বাস্তবতা উন্মোচিত হয়েছে। এই আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছেন প্রকৌশলী, উদ্ভাবক, জলবায়ুকর্মী এবং সমাজসংস্কারক সোনম ওয়াংচুক। তার নেতৃত্বকে এখন অনেকেই আখ্যা দিচ্ছেন ‘জেন-জি ঝড়’— কারণ এই বিক্ষোভের মূল বাহিনী হলো তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা।

বিক্ষোভে ইতোমধ্যেই পাঁচজন নিহত এবং ডজনখানেক আহত হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে লেহ শহরে কারফিউ জারি হয়েছে। বিজেপির স্থানীয় কার্যালয় থেকে শুরু করে সরকারি স্থাপনাগুলোও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের শিকার হয়েছে। লাদাখবাসীর মূল দাবি— রাজ্য মর্যাদা ও সাংবিধানিক সুরক্ষা।

ওয়াংচুক: উদ্ভাবক থেকে জেন-জি নেতা

সোনম ওয়াংচুক শিক্ষাবিদ ও উদ্ভাবক, যিনি এসইসিএমওএল (স্টুডেন্ট’স এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ) প্রতিষ্ঠা করেছেন। তার উদ্ভাবন আইস স্টুপা লাদাখের পানিসঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক খ্যাতি পেয়েছে।

বলিউডের জনপ্রিয় ছবি ‘থ্রি ইডিয়টস’র ‘র‍্যাঞ্চো’ চরিত্রটি ওয়াংচুকের জীবনদর্শন দ্বারা অনুপ্রাণিত।

রাজ্য মর্যাদা ও ষষ্ঠ সূচির অন্তর্ভুক্তির দাবিতে তিনি অনশন শুরু করেন। তার আন্দোলনে ব্যাপকভাবে তরুণ সমাজ যুক্ত হয়েছে।

২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলুপ্তির পর লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এর ফলে স্থানীয়দের সাংবিধানিক সুরক্ষা ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে।

মূল দাবিগুলি হলো: পূর্ণ রাজ্য মর্যাদা

• ৬ষ্ঠ সূচির অধীনে অন্তর্ভুক্তি, যাতে ভূমি ও সম্পদ রক্ষায় স্থানীয়দের ক্ষমতা থাকে
• পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন
• পার্লামেন্টে দুই আসন নিশ্চিত করা
• স্থানীয়দের জন্য চাকরি ও ভূমি সংরক্ষণ

এই দাবিগুলো দীর্ঘদিনের হলেও কেন্দ্রীয় সরকার তা কার্যকর করেনি। ফলে অসন্তোষ জমে গিয়ে এখন বিস্ফোরিত হয়েছে।

সাম্প্রতিক সহিংসতা ও কেন্দ্রের প্রতিক্রিয়া

২৪ সেপ্টেম্বর, লেহ শহর: বিক্ষোভকারীরা বিজেপির কার্যালয়ে আগুন দেয়, সরকারি গাড়ি ভাঙচুর করে।
পুলিশি পদক্ষেপ: টিয়ার গ্যাস, লাঠিচার্জ এবং গুলি চালানো হয়। এতে পাঁচজন নিহত ও অন্তত ৭০ জন আহত হন।
কারফিউ ঘোষণা: পুরো এলাকায় সেনা ও সিআরপিএফ মোতায়েন রয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের অবস্থান: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইঙ্গিত দিয়েছেন, আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করা ছিল ‘ভুল’। ওয়াংচুককে অভিযুক্ত করা হয়েছে যে তিনি তরুণদের উত্তেজিত করেছেন।
প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা: ওয়াংচুকের এনজিও এসইসিএমওএলের বিদেশি অনুদান গ্রহণের লাইসেন্স (এফসিআরএ) বাতিল করা হয়েছে।

কেন ‘জেন-জি ঝড়’

তরুণ নেতৃত্ব ও ছাত্র অংশগ্রহণ: বিক্ষোভকারীদের অধিকাংশই বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজপড়ুয়া ছাত্রছাত্রী।
রাজনৈতিক হতাশা: প্রজন্ম-জেড মনে করছে, তারা গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্ব থেকে বঞ্চিত।
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব: আন্দোলন দ্রুত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে, আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পরিবেশগত সচেতনতা: জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মুখে লাদাখ; এই প্রজন্ম বেশি সচেতন।
গ্লোবাল ট্রেন্ডের প্রতিফলন: পশ্চিম এশিয়া থেকে ইউরোপ পর্যন্ত তরুণ আন্দোলনের যে ধারা চলছে, তার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে লাদাখে।

সহিংসতা আরও বাড়লে কেন্দ্র সরকার কঠোর দমননীতি নিতে পারে। রাজনৈতিক দোষারোপে আন্দোলনের নৈতিক অবস্থান দুর্বল হতে পারে। কেন্দ্রীয় প্রশাসন ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশ্বাসের ঘাটতি বাড়ছে। বিদেশি অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় ওয়াংচুকের সংগঠন সংকটে পড়তে পারে।

কেন্দ্র ও লাদাখ প্রতিনিধিদের ৬ অক্টোবর বৈঠক আন্দোলনের দাবি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ হতে পারে। তরুণ নেতৃত্ব নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে পারে। দীর্ঘদিনের সাংবিধানিক বিতর্কের সমাধান বেরিয়ে আসতে পারে।

লাদাখের এই বিক্ষোভ ভারতীয় রাজনীতিতে এক নতুন মোড় নির্দেশ করছে। এখানে ‘জেন-জি’ প্রজন্ম তাদের ভবিষ্যৎ ও অধিকার নিয়ে সরব হয়েছে। সোনম ওয়াংচুক এখন শুধু একজন উদ্ভাবক বা জলবায়ুকর্মী নন, বরং এক প্রজন্মের প্রতীক।

ভারতীয় গণতন্ত্র ও রাষ্ট্রব্যবস্থার সামনে আজ দ্বৈত চ্যালেঞ্জ— তরুণদের দাবিকে স্বীকৃতি দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান বের করা, নইলে সহিংসতা ও অস্থিরতা আরও দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।

সম্পর্কিত বিষয়:

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন