দুর্যোগ মোকাবিলায় গেল ৪৯ ফায়ার ফাইটারের জীবন
বিশেষ প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৯:১৩, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০২:২৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বাংলাদেশের ইতিহাসে অগ্নিকাণ্ড ও শিল্পাঞ্চলভিত্তিক দুর্ঘটনা বহুবার বড় ট্র্যাজেডি বয়ে এনেছে। আগুন নেভাতে গিয়ে, মানুষকে উদ্ধার করতে গিয়ে কিংবা বিস্ফোরণের কবলে পড়ে জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের সাহসী ফায়ার ফাইটাররা। সর্বশেষ গাজীপুরের টঙ্গীতে রাসায়নিকের গুদামের আগুন নেভানোর সময় দগ্ধ হয়ে মারা গেলেন ফায়ার সার্ভিস লিডার শামীম আহমেদ। তার মৃত্যুতে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া ফায়ার ফাইটারের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৯ জনে। এই সংখ্যা শুধু একটি পরিসংখ্যান নয়, এটি এক মর্মান্তিক ইতিহাস—যেখানে প্রতিটি প্রাণহানি জাতির নিরাপত্তা ও শিল্প সংস্কৃতির দুর্বলতা তুলে ধরে।
শামীম আহমেদ প্রায় ২০ বছর ধরে ফায়ার সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। সম্প্রতি তিনি লিডার পদে পদোন্নতি পান। নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার এক গ্রাম থেকে উঠে এসে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে গেছেন রাজধানীর উপকণ্ঠে। স্ত্রী, তিন সন্তান ও স্বজনদের ভরণপোষণ করে যাচ্ছিলেন তিনি। সোমবারের বিস্ফোরণের পর শতভাগ দগ্ধ হয়ে আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। মঙ্গলবার বিকেলেই চিকিৎসকেরা তার মৃত্যুর সংবাদ দেন। এ মৃত্যু শুধু একটি পরিবারের জন্য নয়, গোটা জাতির জন্য শোকের।
১৯৬৬ থেকে আজ পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪৯ জন ফায়ার ফাইটার
ফায়ার সার্ভিসের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৬৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৪৯ জন ফায়ার ফাইটার বিভিন্ন দুর্ঘটনায় প্রাণ দিয়েছেন। এদের মধ্যে অনেকে বড় অগ্নিকাণ্ডে, কেউ কেউ উদ্ধারকাজে ভবনের ধ্বসে বা বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। প্রতিটি মৃত্যুই দুর্যোগ মোকাবিলায় পেশাদার ঝুঁকির প্রতীক।
১৯৮৯ সালের নাজিমুদ্দিন রোড অগ্নিকাণ্ড, ২০১০ সালের নিমতলী ট্র্যাজেডি এবং ২০১৯ সালের চকবাজার দুর্ঘটনা—প্রতিটি ঘটনায় ফায়ার ফাইটারদের আত্মত্যাগের কথা ইতিহাস হয়ে আছে।
ফায়ার ফাইটারদের মৃত্যু প্রতিবারই একই প্রশ্ন তোলে—আমরা কি যথেষ্ট প্রস্তুত?
কেমিক্যাল গোডাউন ও শিল্পাঞ্চলের ঝুঁকি
অধিকাংশ এলাকায় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার কোনো মানদণ্ড নেই। অনুমোদনবিহীন গুদামগুলোতে রাসায়নিক মজুদের কারণে ছোট আগুন মুহূর্তেই ভয়াবহ হয়ে ওঠে।
সুরক্ষা সরঞ্জামের অভাব: অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র, অগ্নিপ্রতিরোধী পোশাক ও শ্বাসযন্ত্র অনেক সময় পুরোনো বা সীমিত।
পরিকল্পনার দুর্বলতা: আগুন নেভানোর সময় নিরাপদ নির্গমন পথ, বিকল্প পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ও জরুরি চিকিৎসা সহায়তা পর্যাপ্ত নয়।
বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে ফায়ার ফাইটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আধুনিক প্রযুক্তি, রোবটিকস, ড্রোন নজরদারি ও বিশেষ রাসায়নিক প্রতিরোধক ব্যবহৃত হচ্ছে। অথচ বাংলাদেশে এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতিই মূল ভরসা। এর ফলে ঝুঁকি বহুগুণে বাড়ছে।
ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তার জন্য জীবন বাজি রাখেন। তাদের জন্য পর্যাপ্ত ঝুঁকি ভাতা, পরিবারকে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সুরক্ষা ও শিশুদের শিক্ষার নিশ্চয়তা রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব। একইসঙ্গে নগর পরিকল্পনা, শিল্পাঞ্চলে নিরাপত্তা মানদণ্ড কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি।
৪৯ জন ফায়ার ফাইটারের জীবন বলি দিয়ে বাংলাদেশ বারবার সতর্কবার্তা পেয়েছে—নিরাপত্তাহীন শিল্পায়ন ও পরিকল্পনাহীন নগরায়ণের মাশুল দিতে হচ্ছে প্রজন্মের সেরা সাহসীদের। শামীম আহমেদের মৃত্যু সেই তালিকায় নতুন দাগ টেনেছে। এখনই সময় রাষ্ট্র, শিল্পমালিক ও সাধারণ নাগরিক সবার সচেতন হওয়ার। অন্যথায় প্রতিটি অগ্নিকাণ্ড শুধু ধ্বংস নয়, আবারও কেড়ে নেবে সাহসী প্রাণ।