সৌদি গ্র্যান্ড মুফতির আলোচিত ১০ ফতোয়া
হাসান আল মামুন
প্রকাশ: ০০:৩৫, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ০০:৫৪, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫

সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পদ হলো গ্র্যান্ড মুফতি। দীর্ঘদিন এ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন শায়খ আবদুল আজিজ বিন আবদুল্লাহ আলে শায়খ। তিনি মুসলিম বিশ্বের অন্যতম আলোচিত আলেম। ২৩ সেপ্টেম্বর নিজ বাসভবনে তিনি ইন্তেকাল করেছেন। তার মৃত্যুতে সৌদিসহ মুসলিম বিশ্বে নেমে আসে শোকের ছায়া।
বিভিন্ন সময়ে তার দেওয়া ফতোয়া ও ধর্মীয় ব্যাখ্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আলোচনার ঝড় তুলেছে। সৌদির ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক নীতি-নির্ধারণে তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ ভূমিকার মধ্য দিয়েই তিনি সমালোচনার মুখে পড়েছেন বহুবার। তার আলোচিত কিছু ফতোয়া নিয়ে এখানে বিস্তারিত বিবরণী উল্লেখ করা হলো।
টুইটার : ২০১৪ সালে গ্র্যান্ড মুফতি টুইটারকে সব মিথ্যা ও পাপের উৎস বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘এটার সঠিক ব্যবহার হলে তা প্রকৃতই মঙ্গলজনক হতো। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তা গুরুত্বহীন কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। মানুষ এটাকে বিশ্বাসযোগ্য তথ্যের উৎস মনে করে এতে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। কিন্তু এটা মিথ্যা ও অসত্যের উৎস।’ টেলিভিশনে প্রচারিত গ্র্যান্ড মুফতির দেওয়া বক্তব্যকে অনেকে সমর্থন করেছেন, আবার অনেকে বিরোধিতা করেছেন।
দাবা খেলা : ২০১৬ সালে এক টেলিভিশন প্রশ্নোত্তরে তিনি বলেছিলেন, দাবা খেলা ইসলামসম্মত নয়। তার মতে, দাবা খেলায় সময় ও অর্থ অপচয় হয়, এটি মানুষের মনোযোগ সরিয়ে নেয়, কখনও জুয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত হয় এবং খেলোয়াড়দের মধ্যে শত্রুতা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে। এ কারণে তিনি দাবাকে হারাম হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তার এ বক্তব্য শুধু সৌদি আরবেই নয়, সারা বিশ্বে আলোচনার জন্ম দেয়। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো এ নিয়ে অনেক রিপোর্ট করে। সৌদি চেস অ্যাসোসিয়েশন তখন ব্যাখ্যা দিয়ে জানায়, খেলার উদ্দেশ্য যদি শিক্ষামূলক বা বিনোদন হয় তবে তা ভিন্ন বিষয়। কিন্তু গ্র্যান্ড মুফতির এ ঘোষণায় সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয় এবং অনেকেই তার সমালোচনা করেন।
শাসকের প্রতি আনুগত্য : শাসনব্যবস্থা ও শাসকের প্রতি আনুগত্য প্রসঙ্গে তার ফতোয়াগুলোও বহুবার বিতর্কিত হয়েছে। গ্র্যান্ড মুফতি বারবার বলেছেন, মুসলিমদের কর্তব্য হলো শাসককে ভালোবাসা, তাকে রক্ষা করা এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ না করা। এমনকি শাসকের ভুলত্রুটি থাকলেও তাকে অমান্য করা বা তার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অনুমোদিত নয়। তিনি মনে করতেন, রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও মুসলিম সমাজের ঐক্যের জন্য শাসকের প্রতি আনুগত্য অপরিহার্য। সমালোচকরা বলেন, এ ধরনের ফতোয়া মূলত রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে সমর্থন দেওয়ার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ধর্মীয় বৈধতা জোগায়। আঞ্চলিক রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় তার এ ধরনের বক্তব্য বিশেষভাবে আলোচিত হয় এবং বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সমালোচনার মুখে পড়ে।
নারীদের গাড়ি চালানোর বৈধতা : নারী সমাজকে কেন্দ্র করে তার কিছু বক্তব্যও আলোচনায় আসে। বহু বছর ধরে সৌদিতে নারীদের গাড়ি চালানো নিষিদ্ধ ছিল। সামাজিক রক্ষণশীল ধারা নারীর স্বাধীন চলাফেরা সীমিত করে রেখেছিল। তবে যখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সংস্কারের অংশ হিসেবে ২০১৭-২০১৮ সালে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি দেওয়া হয়, তখন গ্র্যান্ড মুফতি এ সিদ্ধান্তকে ধর্মীয়ভাবে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করেন। এর ফলে তাকে কেউ কেউ বাস্তববাদী আখ্যা দিলেও অনেকে মনে করেন, তার এ অবস্থান আসলে রাষ্ট্রীয় নীতির অনুসরণ, ধর্মীয় নেতৃত্বের স্বাধীন সিদ্ধান্ত নয়।
ইরান ও শিয়া সম্প্রদায় : ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়, গ্র্যান্ড মুফতি নাকি বলেছেন, শিয়ারা মুসলিম নয়। সংবাদে ‘এলেজিডলি’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছিল। অর্থাৎ তিনি যে বলেছেন সেটার নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে এ ধরনের সংবাদ প্রচার হতেই তা সারা মুসলিম বিশ্বে তীব্র আলোড়ন সৃষ্টি করে। শিয়া সম্প্রদায় এবং শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো এ মন্তব্যের নিন্দা জানায়। যদিও পরে এ বিষয়ে পরিষ্কার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি, তবু তার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টির অভিযোগ তোলা হয়। এটি তার সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনাগুলোর অন্যতম একটি।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি : গ্র্যান্ড মুফতির আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মুহূর্তে প্রায়ই রাষ্ট্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফতোয়া দিতেন। ফলে তাকে অনেক সময় ‘রাষ্ট্রপন্থী আলেম’ বলা হতো। সমালোচকরা মনে করতেন, তার ফতোয়া ধর্মীয় স্বাধীন চিন্তার প্রতিফলন নয়, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে সমর্থন ও বৈধতা দেওয়ার হাতিয়ার। আবার তার সমর্থকরা বলতেন, ইসলামে ফেতনা ও বিশৃঙ্খলা এড়ানো জরুরি, তাই রাষ্ট্রের নীতিকে সমর্থন করা মুসলিম সমাজের ঐক্য রক্ষার অংশ।
আধুনিকতার নামে পাপে জড়ানো : নারী-পুরুষের অবাধ সম্পর্ক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান কিংবা ধর্মীয় অনুশাসন সম্পর্কিত বিভিন্ন ছোটখাটো ফতোয়া নিয়েও তিনি আলোচিত হন। উদাহরণস্বরূপ আধুনিক চুলের স্টাইল, পশ্চিমা ধাঁচের পোশাক, সঙ্গীত ও নৃত্য অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ ইত্যাদি বিষয়কে তিনি নিন্দনীয় ও পাপকর্ম বলে মন্তব্য করেছেন। এসব বক্তব্য অনেক তরুণ প্রজন্মের কাছে অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে, আবার রক্ষণশীল শ্রেণির কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে।
তথ্য-প্রযুক্তি : প্রযুক্তি, শিক্ষা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়েও তার কিছু মন্তব্য আলোচনায় আসে। তিনি একাধিকবার সতর্ক করে বলেছেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মুসলিম তরুণদের বিভ্রান্ত করছে, এতে সময় নষ্ট হচ্ছে এবং নৈতিকতা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যদিও অনেকে এ কথায় যুক্তি খুঁজে পান, তবুও সমালোচকরা বলেন, প্রযুক্তি ও আধুনিকতার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সমাজকে পিছিয়ে দেয়।
অনুমতি ছাড়া হজ : ২০২৫ সালের জুন মাসে হজের জন্য অনুমতি ছাড়া পবিত্র স্থানগুলোতে গমন শরিয়া এবং রাষ্ট্রীয় আইনের পরিপন্থী বলে ফতোয়া দেন গ্র্যান্ড মুফতি। তিনি বলেন, ‘অনুমতি ছাড়া হজে অংশগ্রহণ শুধু শরিয়াবিরোধীই নয়, বরং তা একটি গুরুতর আইন লঙ্ঘন। এটি জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা জনস্বার্থবিরোধী ও অনুচিত কাজ। সরকার অনুমোদিত নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা শরিয়া নীতির বিরুদ্ধে পড়ে। এটা কেবল আইন অমান্য নয়, বরং ধর্মীয় দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার শামিল।’
সামাজিক মাধ্যমে ইবাদতের ছবি : ২০২৫ সালের মার্চে সামাজিক মাধ্যমে নামাজ ও খুতবা পোস্ট করা যাবে না মর্মে ফতোয়া দেন গ্র্যান্ড মুফতি। ফতোয়ায় তিনি ইমাম ও ধর্ম প্রচারকদের আন্তরিক হতে এবং ভণ্ডামি ও লোক দেখানো কর্মকাণ্ড এড়িয়ে চলার আহ্বান জানান। তিনি পবিত্র রমজান মাসে মসজিদে নামাজ ও খুতবা ভিডিও করা এবং পোস্ট করাকে আন্তরিকতার সঙ্গে অসঙ্গতির উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
তার ফতোয়া শুধু সৌদি সমাজেই প্রভাব ফেলেনি, বরং মুসলিম বিশ্বের বহু দেশেই আলোচিত হয়েছে। কারণ সৌদি আরবের ধর্মীয় নেতৃত্বকে অনেকে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম কেন্দ্রীয় কণ্ঠস্বর হিসেবে মানে। ফলে তার কোনো বক্তব্য বা ফতোয়া প্রচারিত হলে তা দ্রুত আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ছড়িয়ে পড়ে।
গ্র্যান্ড মুফতির জীবন ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। তিনি ছিলেন ইমাম মুহাম্মদ ইবনে আবদুল ওয়াহহাবের বংশধর, যার কারণে আলে শায়খ পরিবার সৌদি আরবে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় নেতৃত্ব ধরে রেখেছে। তাই তার প্রতিটি মন্তব্য শুধু ব্যক্তিগত মতামত নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ও ধর্মীয় প্রভাবের অংশ হিসেবেই বিবেচিত হতো। এ কারণে তার প্রতিটি ফতোয়া মুসলিম সমাজে গভীর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
তিনি ছিলেন এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে কাজ করেছেন। তার অনেক বক্তব্য ইসলামি অনুশাসনের ভিত্তিতে হলেও বাস্তবতায় সেগুলোকে রাষ্ট্রীয় নীতির অনুগামী হিসেবে দেখা হয়েছে। দাবা খেলার নিষেধাজ্ঞা, শাসকের প্রতি নিঃশর্ত আনুগত্য, শিয়া সম্প্রদায় নিয়ে মন্তব্য কিংবা নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমোদনকে বৈধতা দেওয়া, এসবই তাকে আলোচিত ও সমালোচিত করেছে। কেউ তার এসব ফতোয়াকে ইসলামের সঠিক প্রতিফলন হিসেবে দেখেন, আবার কেউ দেখেন রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ হিসেবে। কিন্তু এটুকু সত্য যে, তার দেওয়া ফতোয়া ও বক্তব্য সৌদি সমাজের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। মুসলিম বিশ্বের সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি ছিলেন এক আলোচিত চরিত্র। মহান আল্লাহ তাকে জান্নাতের সুউচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।
তথ্যসূত্র : টাইম ম্যাগাজিন, কার্নেগি এন্ডাউমেন্ট, দ্য নিউ আরব, মরক্কো ওয়ার্ল্ড নিউজ, আল আরাবিয়া নিউজ