বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

| ১৪ কার্তিক ১৪৩২

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কবে

সমাজকাল ডেস্ক

প্রকাশ: ০৭:১৯, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

জুলাই সনদ বাস্তবায়নে গণভোট কবে

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ‘জুলাই জাতীয় সনদ’। সংবিধান সংস্কার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন কাঠামো গঠনের উদ্দেশ্যে প্রস্তাবিত এই সনদকে ঘিরে চলছে তীব্র আলোচনা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ইতোমধ্যে সনদ বাস্তবায়নের জন্য তাদের সুপারিশ সরকারের কাছে জমা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন একটাই—গণভোট কবে হবে? ২৮ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে কমিশনের পক্ষ থেকে জমা দেওয়া হয় 'জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫' শিরোনামের প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে বিস্তারিত বলা হয়েছে, সংবিধানের যেসব অংশে সংস্কারের প্রস্তাব আনা হয়েছে, তা জনগণের মতামতের ভিত্তিতে অনুমোদন নেওয়ার জন্য গণভোট আয়োজন করা হবে। তবে এই ভোটের তারিখ বা সময় কমিশন উল্লেখ করেনি। সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা পুরোপুরি সরকারের হাতে থাকবে।

সুপারিশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে আদেশটি গেজেটে প্রকাশ করা হবে। সেই আদেশের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে একটি তফসিল, যেখানে প্রস্তাবিত সংবিধান সংশোধনের ধারা ও উপধারাগুলো স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে। পরবর্তীতে সেই তফসিলের বিষয়বস্তু জনগণের সামনে গণভোটের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হবে।

গণভোটে একটি মাত্র প্রশ্ন থাকবে—‘আপনি কি জুলাই জাতীয় সনদ (সংবিধান সংস্কার) বাস্তবায়ন আদেশ, ২০২৫ এবং এর তফসিল-১ এ উল্লিখিত সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবগুলোর প্রতি সম্মতি প্রদান করছেন?’ ভোটাররা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’—এই দুই বিকল্পের মধ্যে একটি বেছে নেবেন। যদি জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেন, তাহলে সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু হবে। আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংসদ সেই সংশোধন কার্যকর করতে না পারলে, সুপারিশ অনুযায়ী তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সংবিধানে যুক্ত হয়ে যাবে।

গণভোট কবে হবে, সেটি এখনো পরিষ্কার নয়। সরকারের অভ্যন্তরীণ সূত্র জানায়, দুটি সম্ভাব্য সময়সূচি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। প্রথমটি হলো আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনই গণভোট আয়োজন করা, আর দ্বিতীয়টি নির্বাচনের কিছুদিন আগে তা সম্পন্ন করা। নির্বাচন কমিশন ও সরকারের মধ্যে এ নিয়ে আলোচনাও শুরু হয়েছে, তবে এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি।

রাজনৈতিক দলগুলোও এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থানে আছে। বিএনপি মনে করে, নির্বাচন ও গণভোট একসঙ্গে হলে জনগণের অংশগ্রহণ ও আগ্রহ বাড়বে। তাদের মতে, আলাদা সময়ে গণভোট আয়োজন করলে তা রাজনৈতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টি বলছে, নির্বাচন আগে গণভোট সম্পন্ন করা উচিত, যাতে নতুন সরকার সেই ফলাফলের ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে পারে।

কমিশনের বক্তব্য, সময় নির্ধারণের দায়িত্ব সরকারের ওপরই থাকবে। তারা কোনো নির্দিষ্ট তারিখ বা সময়সীমা সুপারিশ করেনি।

সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, এই প্রক্রিয়াকে আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে হলে নতুন অধ্যাদেশ বা আইন প্রণয়ন প্রয়োজন হবে। বর্তমান সংবিধানে গণভোট সংক্রান্ত যে বিধান আছে, তা সংসদে পাস হওয়া কোনো বিলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু জুলাই সনদের বিষয়টি আলাদা, কারণ এটি সরাসরি জনগণের মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র কাঠামো সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে আসছে। তাই আইনগত দিকটি আগে পরিষ্কার করা না হলে পুরো উদ্যোগই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস বলেন, 'গণভোট আয়োজন কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি সংবিধানের গভীর অংশ। তাই এটি পরিচালনায় আইনি স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক ঐকমত্য দুটোই দরকার।'

গণভোটে অনুমোদন পাওয়ার পর গঠিত হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’। সংসদ সদস্য, বিশেষজ্ঞ, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও প্রাক্তন বিচারপতিদের সমন্বয়ে এই পরিষদ ২৭০ কার্যদিবসের মধ্যে চূড়ান্ত সংবিধান সংশোধনের খসড়া তৈরি করবে। এরপর সংসদে তা উপস্থাপন করা হবে এবং অনুমোদনের পর নতুন সাংবিধানিক কাঠামো কার্যকর হবে।

সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে, কমিশনের সুপারিশ এখন আইনি যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে আছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আইন মন্ত্রণালয় ও নির্বাচন কমিশন একত্রে কাজ করছে একটি ‘খসড়া কর্মপরিকল্পনা’ তৈরির জন্য। তাদের দায়িত্ব—আইনি কাঠামো নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও জনসচেতনতা প্রচারণার কৌশল তৈরি করা।

প্রধান উপদেষ্টা দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, 'ডিসেম্বরের মধ্যেই গণভোটের প্রস্তাব সংসদে তোলা হতে পারে। তবে সেটি সম্পূর্ণ নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিবেশের ওপর। কোনো পক্ষের আপত্তি থাকলে প্রক্রিয়া বিলম্বিত হতে পারে।'

বিশেষজ্ঞদের মতে, জুলাই জাতীয় সনদের সাফল্য নির্ভর করবে তিনটি বিষয়ের ওপর—এক, রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও অংশগ্রহণ; দুই, জনগণের সচেতন অংশগ্রহণ; এবং তিন, গণভোটের প্রক্রিয়ায় পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক আনিসুজ্জামান খান বলেন, 'এই গণভোট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হতে পারে। কারণ, এটি কেবল সংবিধান সংশোধন নয়, বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি পুনর্গঠনেরও প্রক্রিয়া।'

তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, 'যদি সরকার একতরফাভাবে সময় ও নিয়ম নির্ধারণ করে, তাহলে এটি নতুন রাজনৈতিক সংকট তৈরি করতে পারে।'

অন্যদিকে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অনেকেই মনে করছেন, দীর্ঘদিনের অচলাবস্থা দূর করতে জুলাই সনদ প্রয়োজন। তবে জনগণের কাছে প্রস্তাবগুলো কতটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটাই হবে মূল বিষয়।

সরকারি সূত্রে জানা গেছে, গণভোট সফল করতে দেশের প্রতিটি উপজেলায় নাগরিক সংলাপ আয়োজনের পরিকল্পনা আছে। সেখানে নাগরিকদের মতামত নেওয়া হবে এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় প্রচার-প্রচারণা চালানো হবে।

সবকিছু মিলিয়ে, জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের যাত্রা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে। কমিশনের কাজ শেষ হলেও সরকারের সামনে রয়েছে বড় দায়িত্ব—গণভোটের সময়, কাঠামো ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ। অনেকেই একে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর মুহূর্ত হিসেবে দেখছেন।

এই গণভোট কেবল সংবিধান পরিবর্তনের বিষয় নয়; এটি আসলে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতির দিকনির্দেশনা নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সরকার বলছে, জনগণের অংশগ্রহণই হবে সবচেয়ে বড় শক্তি। এখন পুরো জাতির দৃষ্টি সেই ঘোষণার দিকেই—গণভোট কবে হবে, সেটিই ঠিক করবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের পরবর্তী ধাপ।

সম্পর্কিত বিষয়:

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন

শীর্ষ সংবাদ:

তিন বিচারপতিকে নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের ব্যাখ্যা শোকজ নয়, তথ্য চাওয়া হয়েছে
স্বর্ণের দামে বড় পতন এক দিনে ভরিতে কমল ১০ হাজার টাকার বেশি
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা অবাক হলেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে পাল্টা প্রশ্ন না করায়
১০ রেফারির বাজি প্রায় ২০ হাজার ম্যাচে...!
জুলাই সনদ বাস্তবায়নের সুপারিশ প্রধান উপদেষ্টার হাতে
ব্যানার ছেঁড়ার জেরে বন্দুকযুদ্ধ: চট্টগ্রামের ছাত্রদল কর্মী নিহত, আহত ১৫ জন
অন্য প্রতীক দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে ইসি
বন্ধ হতে পারে ৪ কোটি নাগরিকের খাদ্য ভর্তুকি
যুক্তরাষ্ট্রে টানা চার সপ্তাহ ধরে শাটডাউন বন্ধ হতে পারে ৪ কোটি নাগরিকের খাদ্য ভর্তুকি
ত্রয়োদশ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্র ৪২৭৬১ ও ভোটকক্ষ ২৪৪৬৪৯
‘শাপলা’ পাচ্ছে না এনসিপি অন্য প্রতীক দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে ইসি
বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে আগ্রহ পাকিস্তানের
নিউইয়র্কে আগাম ভোটে এগিয়ে মুসলিম মেয়রপ্রার্থী মামদানি
কার্যক্রম চলমান থাকবে, নভেম্বরের মধ্যে শেষ নয়
দুই দশক পর ঢাকায় বাংলাদেশ-পাকিস্তান জেইসি বৈঠক শুরু
নয়াদিল্লি-বেইজিং উষ্ণতায় ফিরছে চালু হলো ভারত -চীন সরাসরি ফ্লাইট