মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ও সমর্থন কী ধরনের ছিল?
প্রকাশ: ২০:৪৮, ৮ ডিসেম্বর ২০২৫
আজিজুর রহমান আসাদ
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকা ছিল সরাসরি, বিস্তৃত এবং নির্ণায়ক। ভারতের সমর্থন না থাকলে মুক্তিযুদ্ধ আরও দীর্ঘ, কঠিন ও রক্তক্ষয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি ছিল। ভারতের সমর্থন ছিল সর্বাত্মক: রাজনৈতিক + কূটনৈতিক + মানবিক + সামরিক + লজিস্টিক + গোয়েন্দা। সব ধরনের সমন্বিত সহায়তার ফলে মাত্র ৯ মাসে দ্রুত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়। ভারতের অংশগ্রহণ না থাকলে যুদ্ধ আরও অনেক দীর্ঘ হতো এবং গণহত্যার মাত্রা বিপুলভাবে বাড়ত, এটি প্রায় নিশ্চিত।
ভারতের ভূমিকা ও সমর্থন কী ধরনের ছিল?
১. রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমর্থন
ভারত ছিল প্রথম দেশ, যে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে সমর্থন করে। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বনেতাদের (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফ্রান্স ইত্যাদি) কাছে পাকিস্তানের গণহত্যার বিষয়টি তুলে ধরেন। জাতিসংঘে পাকিস্তানের অবস্থান দুর্বল করতে ভারত ব্যাপক কূটনৈতিক প্রচারণা চালায়, যার ফলে আন্তর্জাতিক জনমত বাংলাদেশের পক্ষে যায়।
২. শরণার্থী সংকট মোকাবিলা
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হলে প্রায় এক কোটিরও বেশি বাঙালি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত এ শরণার্থীদের খাদ্য, চিকিৎসা, আশ্রয় ও নিরাপত্তা দিয়ে মানবিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে। এই বিশাল মানবিক চাপও ভারতকে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় সহায়তা দিতে প্ররোচিত করে, কারণ যুদ্ধ দীর্ঘ হলে শরণার্থী সংকট আরও বর্ধিত হতো।
৩. মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও লজিস্টিক সহায়তা
ট্রেনিং ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতের বিভিন্ন সামরিক সংস্থা ও আর্মি মিলে মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ করে, যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে দেয়, গোপন তথ্য সংগ্রহে সহায়তা প্রদান করে। মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক বড় অপারেশন যেমন: বর্ডার পোস্ট দখল, যোগাযোগ লাইন বিচ্ছিন্ন করা, ভারত সমন্বয় করে।
৪. মিত্র বাহিনী (Joint Command) গঠনে সহায়তা
অক্টোবর ১৯৭১-এ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনী যৌথভাবে “মিত্র বাহিনী” গঠন করে। এর ফলে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ সম্ভব হয়, যা তাদের প্রতিরোধ দ্রুত ভেঙে ফেলে।
৫. সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ (৩–১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১)
পাকিস্তান ভারতের ওপর বিমান হামলা করলে ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়। ভারতীয় স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের চার দিক দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। ১৩ দিনের মধ্যেই পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় সেনা-আত্মসমর্পণ। ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপই যুদ্ধের দ্রুত সমাপ্তি ঘটায় এবং সম্ভাব্য বিস্তৃত গণহত্যা ঠেকায়।
৬. আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে সোভিয়েত সমর্থন নিশ্চিত করা
যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করছিল। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে Indo-Soviet Treaty of Peace, Friendship and Cooperation (1971) স্বাক্ষর করে, যাতে ইউএন নিরাপত্তা পরিষদেও পাকিস্তানকে রক্ষা করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এই চুক্তি ছাড়া পাকিস্তান আরও শক্ত আন্তর্জাতিক সমর্থন পেতে পারত, যা যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করত।
৭. মানবিক সংকট ও গণহত্যা কমাতে গুরুত্ব
ইতিহাসবিদদের মতে, ভারতের দ্রুত সামরিক আগ্রাসন না হলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা আরও মাসের পর মাস চলতে পারত, ফলে মৃত্যুর সংখ্যা লাখের পর লাখ বাড়তে পারত। ১ কোটি শরণার্থী ভারতে আটকে থাকায় মানবিক সংকট ভয়াবহ রূপ নিত। ভারতের হস্তক্ষেপ বাঙালিদের ওপর সংঘটিত পরিকল্পিত গণহত্যা দ্রুত থামানোর জন্য ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পাকিস্তানপন্থি জামায়াত-শিবির-রাজাকার-আলবদরের রাজনীতির ধারাবাহিকতা বাংলাদেশে বহমান। এদের ভারত বিরোধিতার কারণ ১৯৭১ সালের পরাজয়ের জ্বালা। প্রতিবেশী হিসেবে ভারতের সাথে সমস্যা কূটনৈতিক উপায়ে সমাধান করার বদলে, এরা ভারত বিরোধিতার যে রাজনীতি করে, তা মূলত ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকার জন্য।
লেখক: গবেষক
* মতামত লেখকের নিজস্ব
