বিবিএস জরিপ
১০ শিশুর ৪ জনের রক্তে ’উদ্বেগজনক’ মাত্রায় সীসা, বেড়েছে সিজারিয়ান
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫:১৪, ১৬ নভেম্বর ২০২৫
জরিপ ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫’ (এমআইসিএস ২০২৫) এর প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ। ছবি: সংগৃহীত
দেশে প্রায় প্রতি ১০ জন শিশুর মধ্যে ৪ জনের রক্তেই 'উদ্বেগজনক' মাত্রায় সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১২-৫৯ মাস বয়সী শিশুদের ৩৮ শতাংশের (অর্থ্যাৎ প্রায় প্রতি ১০ জনে চারজন শিশু) এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের প্রায় ৮ শতাংশের রক্তে সীসার মাত্রা 'নিরাপদ সীমার চেয়ে বেশি'।
এমনকি রক্তে সবচেয়ে বেশি সীসা পাওয়া গেছে ঢাকায়, মোট সীসায় আক্রান্তের ৬৫ শতাংশ।
ইউনিসেফ ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নতুন জরিপে এইা তথ্য উঠে এসেছে।
জরিপের তথ্য অনুযায়ি, সীসায় আক্রান্ত শিশুদের অর্ধেকের বেশি ধনী এবং ৩০ শতাংশ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর।
ইউনিসেফ বলছে, সীসা দূষণ শিশুদের মস্তিষ্কের বিকাশে হুমকি সৃষ্টি করে এবং এর প্রভাব সব আর্থ-সামাজিক শ্রেণির ওপরই পড়ছে।
রবিবার (১৬ নভেম্বর) রাজধানীতে ইউনিসেফ ও অন্যান্য অংশীদারদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) দেশে শিশু ও নারীদের ওপর পরিচালিত সবচেয়ে বিস্তারিত জরিপ ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০২৫’ (এমআইসিএস ২০২৫) এর এই প্রাথমিক ফলাফল প্রকাশ করে।
বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান এবং বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রায় ৬৩ হাজার পরিবারের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত এ জরিপে শিশুদের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, সুরক্ষা ও বিকাশে বিদ্যমান অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ তুলে ধরা হয়েছে।
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, জরিপের ফলাফল থেকে দেশের সব বিভাগ, জেলা এবং তিনটি সিটি করপোরেশন এলাকার পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে, যা নীতিনির্ধারকদের বৈষম্যের ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করে লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপ নিতে সহায়তা করবে।
শিশুশ্রমের হার বেড়েছে
জরিপের তথ্য অনুযায়ি, দেশে শিশুশ্রমের হারও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ৫-১৭ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে শিশুশ্রমের হার এখন ৯ দশমিক ২ শতাংশ; যা ২০১৯ সালের এই জরিপে ছিল ৬ দশমিক ৮ শতাংশ।
অর্থাৎ গত ছয় বছরে দেশে শিশুশ্রমের হার বেড়েছে ২ দশমিক ৪ শতাংশ। এই শিশুশ্রম বেশি বেড়েছে উত্তরাঞ্চলে।
রাজশাহী বিভাগে শিশুশ্রমের হার ১২ দশমিক ৪ শতাংশ এবং রংপুরে এর হার ১১ দশমিক ৮ শতাংশ।
এর ফলে দেশে 'আরও ১২ লাখ শিশু ঝুঁকিতে পড়েছে' বলে তুলে ধরে ইউনিসেফ।
সন্তান প্রসবে বেড়েছে সিজারিয়ান
জরিপে আরও বলা হয়েছে, পূর্বের জরিপে যেখানে সিজারিয়ান সেকশনের (অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তানপ্রসব) হার ছিল ৯ শতাংশের মতো, সেটি নতুন জরিপে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২ শতাংশে। দরিদ্রের মধ্যে এ হার ৩৪ শতাংশ এবং ধনীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ।
ইউনিসেফ বলেছে, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বর্তমানে ৭৫ শতাংশে প্রসবের ক্ষেত্রে সিজারিয়ান সেকশনের হার বৃদ্ধি 'স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অর্থনৈতিক চাপ' উভয়ই বাড়াচ্ছে।
শিশুমৃত্যু ও বাল্যবিবাহ কমেছে
জরিপে অবশ্য শিশু মৃত্যুর হার এবং বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে কিছুটা ইতিবাচক ফলাফল এসেছে। বাল্যবিবাহের হার ২০১৯ সালের ৫১ দশমিক ৪ শতাংশ থেকে কমে ৪৭ শতাংশে নেমে এসেছে, তবে এখনও প্ৰায় অর্ধেক মেয়ের ১৮ বছর বয়সের আগেই বিয়ে হয়ে যায়।
এছাড়া নবজাতকের ক্ষেত্রে প্রতি হাজারে মারা যায় ২২ জন, যা পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মোট মৃত্যুর (৩৩ শিশু) ৬৭ শতাংশ। পূর্বের জরিপে এ সংখ্যা ছিল ২৪।
চলতি বছরের শুরুতে জরিপের সময়ে শিশু মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে সিলেটে (২৯) এবং ঢাকায় (২৫)। সবচেয়ে কম মিলেছে খুলনা (১৫) এবং ময়মনসিংহ (১৮) বিভাগে।
যে নারীর বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে তাদের প্রত্যেক শিশু জন্মদানের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জরিপের ফল ধরা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো শিশুর মৃত্যু হলে তা জন্মের কতদিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে, সেই হিসেবটি আমলে নেওয়া হয়েছে।
অনুষ্ঠানে ইউনিসেফের পরামর্শ
ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ার্স বলেন, “বাল্যবিবাহ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাস প্রমাণ করে যে অগ্রগতি সম্ভব, কিন্তু সীসা-দূষণ এবং শিশুশ্রমের মতো সংকট লাখ লাখ শিশুকে তাদের সম্ভাবনা থেকে বঞ্চিত করছে, এবং বেড়ে চলা সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের হার নারীদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি করছে।
এই কর্মকর্তা আরও বলেন, "যখন প্রতিটি শিশুর বেঁচে থাকা, বিকশিত হওয়া ও শেখার অধিকারকে সম্মান করা হবে, তখন এটি অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশের মাধ্যমে পরিমাপ করা যাবে।"
জরিপের এসব ফলাফল ধরে সরকারের নীতি গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, "এই তথ্যকে সুনির্দিষ্ট কাজে পরিণত করতে এবং কোনো শিশু যাতে বাদ না পড়ে সেই লক্ষ্যে পরিবর্তন আনতে সরকারকে সহায়তা করতে ইউনিসেফ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।”
