৭,৫০০ চিকিৎসকের পদোন্নতি, স্বাচিপ বাদ, তীব্র প্রতিক্রিয়া
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৯:০১, ১ নভেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১০:২৪, ১ নভেম্বর ২০২৫
সরকারি স্বাস্থ্যখাতে দীর্ঘদিনের স্থবিরতা কাটিয়ে একযোগে ৭,৫০০ চিকিৎসককে পদোন্নতির সিদ্ধান্ত দিয়েছে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়। তবে এই সিদ্ধান্ত প্রকাশের আগেই চিকিৎসক সমাজে তৈরি হয়েছে তীব্র প্রতিক্রিয়া। অভিযোগ উঠেছে—আওয়ামী লীগ–সমর্থিত চিকিৎসক সংগঠন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) অনেক সদস্য এবার পদোন্নতির তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২৫ সালের মার্চ মাস থেকে চিকিৎসকদের প্রশাসনিক ও একাডেমিক পদে নিয়মিত পদোন্নতির প্রক্রিয়া শুরু হয়। কয়েক ধাপে যাচাই-বাছাই শেষে গত ২৭ অক্টোবর তালিকা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রাথমিকভাবে প্রায় ৮,২০০ চিকিৎসকের নাম প্রস্তাব করা হলেও যাচাই শেষে ৭,৫০০ জনের নাম চূড়ান্ত করা হয়।
তালিকায় সহকারি অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক এবং সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পাওয়া চিকিৎসক রয়েছেন। তাদের মধ্যে ৫,৮৬০ জন মেডিকেল কলেজ ও সরকারি হাসপাতালে কর্মরত, বাকি ১,৬৪০ জন কর্মরত জেলা হাসপাতাল ও প্রশাসনিক দপ্তরে। পদোন্নতির গেজেট প্রকাশের জন্য ফাইল এখন প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। অনুমোদন পেলেই এই মাসের মধ্যেই তা প্রকাশ করা হবে।
তবে স্বাচিপের অনেক সদস্যের নাম বাদ পড়ায় সংগঠনটির ভেতরে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। স্বাচিপের এক যুগ্ম সম্পাদক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, 'আমাদের বহু সিনিয়র চিকিৎসক আছেন, যারা ২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকারি হাসপাতালে কর্মরত। তাদের বাদ দিয়ে অনেক জুনিয়রকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এটি মেধার অবমূল্যায়ন।'
অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, 'তালিকা তৈরিতে রাজনৈতিক বিবেচনা নয়, নিয়ম ও যোগ্যতাই মুখ্য ছিলো। যাদের বাদ দেওয়া হয়েছে, তাদের নথি অসম্পূর্ণ ছিলো বা প্রশাসনিক কারণ ছিলো। তারা চাইলে লিখিত আপিল করতে পারবেন।'
তবে বাদ পড়া চিকিৎসকদের অভিযোগ, পদোন্নতির ক্ষেত্রে পেশাগত দক্ষতার চেয়ে সম্পর্ক, সুপারিশ ও প্রভাবকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের এক সহযোগী অধ্যাপক বলেন, 'চিকিৎসকদের পদোন্নতি নিয়ে প্রশাসনে এখন অদৃশ্য রাজনীতি চলছে। কেউ সিনিয়র হয়েও জুনিয়রের অধীনে পড়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ হঠাৎ করে শীর্ষ পদে চলে যাচ্ছেন।'
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে (২০০৯–২০২৪) সরকারি চিকিৎসক পদে সর্বশেষ বড় পরিসরের পদোন্নতি হয়েছিলো ২০২১ সালের নভেম্বরে, তখন ৬,২০০ চিকিৎসক পদোন্নতি পান। এবার সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো ৭,৫০০ জনে, যা ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
তবে রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রশাসনিক পক্ষপাতের অভিযোগ এবার সবচেয়ে বেশি। চিকিৎসকদের সংগঠনগুলোর মধ্যে এখন স্পষ্ট বিভাজন দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) বলছে, পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা ও সিনিয়রিটি বজায় না থাকলে স্বাস্থ্যসেবা ও একাডেমিক গবেষণায় নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বিএমএর এক নেতা বলেন, 'চিকিৎসক সমাজে আস্থার সংকট তৈরি হলে তার ফল ভোগ করবে জনগণ। পদোন্নতি শুধু মর্যাদা নয়, এটি পেশাগত স্বীকৃতি।'
স্বাচিপের কেন্দ্রীয় কমিটির কয়েকজন সদস্য মনে করছেন, প্রশাসনে ভেতরে-বাইরে এখন ভিন্নমতের গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে। তাঁদের মতে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষার অংশ হিসেবেই পদোন্নতির তালিকা কিছুটা পরিবর্তন করা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনবিদ অধ্যাপক একে রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, 'যে কোনো সরকারি পদোন্নতি প্রক্রিয়া যদি স্বচ্ছ না হয়, তাহলে সেটা কর্মীদের মনোবল ভেঙে দেয়। স্বাস্থ্যখাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে।'
মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) জাহিদুল ইসলাম একটি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, 'চিকিৎসকদের পদোন্নতির বিষয়ে আমরা সম্পূর্ণ নিয়ম মেনে কাজ করেছি। যাঁদের বাদ পড়ার অভিযোগ আছে, তাঁরা লিখিতভাবে আবেদন করলে পুনর্বিবেচনা করা হবে। এটি কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নয়।'
তবে বাস্তবে, চিকিৎসকদের ভেতরে অস্থিরতা বেড়েছে। অনেকে পদোন্নতি না পাওয়ার কারণ জানতে মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন, কেউ কেউ আইনি পদক্ষেপের কথাও ভাবছেন। বিশেষ করে ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরগুলোতে কর্মরত চিকিৎসকদের মধ্যে পদোন্নতির খবর প্রকাশের পর থেকেই অসন্তোষ ও গোপন আলোচনা বাড়ছে।
চিকিৎসকদের একটি অংশ মনে করছেন, প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের মধ্যে রাজনৈতিক প্রভাব রোধ না করা গেলে ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যখাতের দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাঁরা বলছেন, 'আমরা চিকিৎসা করি মানুষের জন্য, রাজনীতির জন্য নয়। কিন্তু এখন প্রতিটি সিদ্ধান্তেই রাজনীতির ছায়া।'
সরকারি সূত্রে জানা গেছে, পদোন্নতির গেজেট আগামী ১৫ নভেম্বরের মধ্যে প্রকাশের প্রস্তুতি চলছে। এরপর থেকেই পদোন্নতিপ্রাপ্ত চিকিৎসকদের নতুন দায়িত্ব ও বেতনস্কেল কার্যকর হবে।
চিকিৎসা প্রশাসনের পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ৭,৫০০ চিকিৎসকের পদোন্নতি নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যখাতে একটি বড় পদক্ষেপ, তবে যেভাবে তা ঘিরে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, তাতে পুরো প্রক্রিয়াটি প্রশ্নের মুখে পড়েছে। এই পদোন্নতি এখন শুধু প্রশাসনিক প্রক্রিয়া নয়, বরং চিকিৎসক সমাজে আস্থার সংকট ও রাজনৈতিক ভারসাম্যের এক নতুন ইঙ্গিত হয়ে উঠেছে।
