বুধবার, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

| ১৪ কার্তিক ১৪৩২

এসডোর গবেষণা

দেশে ৪২% রঙে উচ্চ মাত্রায় ক্ষতিকর সীসা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৮:৩৯, ২৯ অক্টোবর ২০২৫

দেশে ৪২% রঙে উচ্চ মাত্রায় ক্ষতিকর সীসা

বাংলাদেশে বাড়ি রঙ করতে ব্যবহৃত বিভিন্ন কোম্পানির রঙে ১ লাখ ৯০ হাজার পিপিএম পর্যন্ত মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। অথচ আইন অনুযায়ী রঙে সীসা ব্যবহারের নিরাপদ মাত্রা সর্বোচ্চ ৯০ পিপিএম। অবশ্য এসব কোম্পানি মূলত ছোট, স্থানীয় বা অনিবন্ধিত।  

এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) এর এক গবেষণায় বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া ডেকোরেটিভ রঙে সীসার এই উদ্বেগজনক মাত্রার তথ্য উঠে এসেছে। গত মঙ্গলবার এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। 

গবেষণায় বলা হয়েছে, পরীক্ষিত মোট ১৬১টি নমুনার মধ্যে ৯৩টি (৫৭.৮%) নমুনায় নিরাপদ মাত্রায় (৯০ পিপিএম-এর কম) সীসা পাওয়া গেছে। এসব নমুনার মধ্যে বাংলাদেশি ও বহুজাতিক উভয় ব্র্যান্ডের (যেমন: বার্জার, এশিয়ান পেইন্টস, নিপ্পন ইত্যাদি) রং রয়েছে। 

অন্যদিকে ৬৮টি নমুনায় (৪২.২%) সীসার মাত্রা বিএসটিআই নির্ধারিত ৯০ পিপিএম-এর ঘর অতিক্রম করেছে। এর মধ্যে ২৬ শতাংশ নমুনায় ১ হাজার পিপিএম-এর বেশি এবং ৩ শতাংশ নমুনায় ৫০ হাজার পিপিএম-এর বেশি সীসা পাওয়া গেছে।

নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রমকারী এই ব্র্যান্ডগুলো মূলত ছোট, স্থানীয় বা অনিবন্ধিত কোম্পানি। এসব কোম্পানির রঙ পরীক্ষাগারে পরীক্ষা বা নিয়ন্ত্রক সংস্থার তদারকির অভাব রয়েছে। 

এ বিষয়ে এসডোর চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সচিব সৈয়দ মার্গুব মোর্শেদ বলেন, “আমরা জনস্বাস্থ্য রক্ষায় সকল প্রকার রং থেকে সীসা নির্মূল করার জন্য কর্তৃপক্ষ এবং শিল্প খাতের স্টেকহোল্ডারদের কাছে অবিলম্বে পদক্ষেপ দাবি করছি। উৎপাদন, বিপণন এবং ব্যবহারে সম্মিলিত দায়বদ্ধতার পক্ষে আমরা কথা বলছি।“

এসডোর সিনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজার শাহরিয়ার হোসেন বলেন, " কেবল আইন প্রণয়ন নয়, তার যথাযথ বাস্তবায়নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের লক্ষ্য কাউকে দোষারোপ করা নয়, বরং একটি সম্মিলিত সংকট মোকাবিলা করা, যেখানে শিল্পকলা, উৎপাদন এবং দৈনন্দিন জীবনে নিরাপত্তাকে অবশ্যই আপসহীন একটি অংশ হতে হবে।”

এসডোর নির্বাহী পরিচালক সিদ্দীকা সুলতানা বলেন, "আমরা যে রং ব্যবহার করি, তা যদি নিরাপদ না হয়, তবে এটি প্রতিটি পরিবার এবং শিল্পীর জন্য জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি এবং মানসিক উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বাংলাদেশে সীসামুক্ত ভবিষ্যৎ অর্জনে আমরা সকল স্টেকহোল্ডারদের সাথে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।"


বিএসটিআই-এর পরিচালক (কেমিক্যাল উইং) খোদেজা খাতুন বলেন, "যেসব ব্র্যান্ড সীসার মানদণ্ড মানছে না, তাদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কিছু প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে, তবে আমরা সেগুলো সমাধানের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।"

কোন ব্র্যান্ডের রঙে কি পরিমান সীসা:

গবেষণার তথ্য অনুযায়ি, ক্যাঙ্গারু ব্র্যান্ডে (১,৯০,০০০ পিপিএম) সীসার সর্বোচ্চ উপস্থিতি রেকর্ড করা হয়েছে। এরপরই রয়েছে ইউরো ব্র্যান্ডের রঙ, যেখানে সীসার পরিমান ১,৭০,০০০ পিপিএম। এর মধ্যে ক্যাঙ্গারু ব্র্যান্ডের নমুনাটি ছিল আমদানিকৃত, এটি বাংলাদেশে তৈরি নয়। কিন্তু ইউরো ব্র্যান্ড বাংলাদেশি। 

অন্যান্য উচ্চ মাত্রার সীসাযুক্ত নমুনার মধ্যে রয়েছে নাহার কোম্পানির রঙ (৮১,০০০ পিপিএম), নিউ টুয়া রঙে (৭৪,০০০ পিপিএম), টপ সিল রঙে (৫৪,০০০ পিপিএম), মদিনা বেটার রুবিল্যাক রঙে (১৯,০০০ পিপিএম), মেঘনা প্লাস রঙে (১৮,০০০ পিপিএম), র‌্যামি রঙে (১৮,০০০ পিপিএম) এবং তুর্কি রঙে (১৬,০০০ পিপিএম)। এই সমস্ত রং হলুদ বা সোনালি-হলুদ রঙের অয়েল ডেকোরেটিভ রং।

গবেষণায় বলা হয়েছে, হলুদ রঙে সর্বোচ্চ সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। লাল এবং সাদা রঙেও সীসার উচ্চ মাত্রা পাওয়া গেছে।

কিছু রং শিল্পকারখানার ব্যবহারের জন্য বাজারজাত করা হলেও সেগুলো ডেকোরেটিভ রঙ হিসেবে বিক্রি হয়।

মাত্র ২২ শতাংশ রঙে (১৬২টির মধ্যে ৩৫টি) ‘সীসামুক্ত’ বা ‘পরিবেশ-বান্ধব’ লেবেল ছিল।

জরিপে অংশ নেওয়া অর্ধেকের বেশি দোকানদার বিএসটিআই-এর সীসার নির্ধারিত মাত্রা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না।

১০ হাজার পিপিএম-এর বেশি সীসাযুক্ত সমস্ত নমুনা ক্ষুদ্র বা অনানুষ্ঠানিক উৎপাদকদের কাছ থেকে এসেছে।

চীন, সিঙ্গাপুর থেকে আমদানি করা কিছু নমুনাতেও উচ্চ মাত্রার সীসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে বলে গবেষণায় জানানো হয়েছে। গবেষকরা বলেছেন, সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ এবং কাস্টমস স্ক্রিনিংয়ের দুর্বলতার কারণে এসব রঙ দেশে আসতে পেরেছে। 

গবেষণায় সুপারিশ

এ গবেষণার আলোকে এসডো বাধ্যতামূলক সেইফটি লেবেল এবং নিয়মিত পণ্য পরীক্ষার সুপারিশ করেছে।

এছাড়া স্বাস্থ্য ঝুঁকি মূল্যায়নের জন্য আরও উন্নত পদ্ধতি ব্যবহার করে গবেষণা পরিচালনা, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব প্যাকেজিং বিকল্প খুঁজে বের করা, টেকসই কৃষি অনুশীলন প্রচার এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় ও প্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় জোরদার করার সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

এ সম্পর্কিত খবর

আরও পড়ুন