লিবিয়ার বিদ্রোহ দিবস: ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩:১০, ১ সেপ্টেম্বর ২০২৫

লিবিয়ার বিদ্রোহ দিবস: ইতিহাস, উত্তরাধিকার ও বর্তমান বাস্তবতা
লিবিয়ার জাতীয় ইতিহাসে ১ সেপ্টেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিনকে বলা হয় বিদ্রোহ দিবস বা আল-ফাতেহ বিপ্লব দিবস। ১৯৬৯ সালে কর্নেল মউআম্মার গাডাফির নেতৃত্বে একদল তরুণ সেনা শান্তিপূর্ণ অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রকে উৎখাত করে নতুন রাজনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করে। প্রায় চার দশক ধরে এই দিনটি রাষ্ট্রীয় আয়োজন ও জাতীয় গৌরবের প্রতীক হিসেবে পালিত হলেও আজ তা লিবিয়ার রাজনীতিতে বিভাজনের এক স্মারক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
১৯৬৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর, যখন রাজা ইদ্রিস বিদেশে চিকিৎসাধীন ছিলেন, তখন মাত্র ২৭ বছর বয়সী সেনা কর্মকর্তা গাডাফি ও তার সহযোদ্ধারা ক্ষমতা দখল করেন। তারা রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে লিবিয়ান আরব রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা করেন। ক্ষমতা গ্রহণের পর Revolutionary Command Council (RCC) রাষ্ট্র পরিচালনা শুরু করে এবং গাডাফিকে চেয়ারম্যান ঘোষণা করে।
গঠনমূলক পরিবর্তন ও গাডাফির দর্শন
বিপ্লবের পরপরই গাডাফির সরকার কিছু বড় সিদ্ধান্ত নেয়—
রাজতন্ত্র ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়।
তেল ও গ্যাস খাত জাতীয়করণ করে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।
১৯৭৭ সালে দেশকে ঘোষিত করা হয় জামাহিরিয়া—অর্থাৎ "জনতার রাষ্ট্র" যেখানে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের ধারণা প্রচারিত হয়।
এই পরিবর্তনগুলো লিবিয়াকে তেলসমৃদ্ধ শক্তিশালী রাষ্ট্রে পরিণত করলেও ধীরে ধীরে গাডাফির শাসন ব্যক্তিনির্ভর স্বৈরতন্ত্রে রূপ নেয়।
উদযাপন ও বিপ্লবের সংস্কৃতি
প্রতি বছর ১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রীয় ছুটি পালন করা হতো। রাজধানী ত্রিপোলির গ্রিন স্কোয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজ, আতশবাজি ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হত। ২০০৯ সালে বিপ্লবের ৪০তম বার্ষিকী উপলক্ষে আন্তর্জাতিক মহলের নজর কাড়ে এমন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান।
বিতর্ক ও বিভাজন
২০১১ সালের আরব বসন্ত–এর সময় লিবিয়ার জনগণ গাডাফি-বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেয়। গৃহযুদ্ধের মাধ্যমে গাডাফির পতন ঘটে এবং বিদ্রোহ দিবসের রাষ্ট্রীয় পালন বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে নতুন সরকার ১৭ ফেব্রুয়ারি বিপ্লব দিবসকে জাতীয় দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
তবে এখনও লিবিয়ার কিছু অঞ্চলে, বিশেষ করে গাডাফি-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো ১ সেপ্টেম্বরকে স্মরণ করে। তারা সবুজ পতাকা উত্তোলন করে এবং গাডাফির ছবি বহন করে। অন্যদিকে বিরোধীরা এই দিনকে "স্বৈরশাসনের সূচনা" হিসেবে চিহ্নিত করে।
বর্তমান প্রেক্ষাপট
আজকের লিবিয়া ভাঙা রাজনৈতিক বাস্তবতায় বিভক্ত—একদিকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সরকার, অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি। এই প্রেক্ষাপটে ১ সেপ্টেম্বরের বিদ্রোহ দিবস আর রাষ্ট্রীয় ঐক্যের প্রতীক নয়, বরং অতীত ও বর্তমানের সংঘাতের প্রতিচ্ছবি।
লিবিয়ার বিদ্রোহ দিবস একদিকে স্বাধীনতা ও পরিবর্তনের স্মারক, অন্যদিকে চার দশকের স্বৈরশাসনের প্রতীক। গাডাফির শাসনকালের অর্থনৈতিক সাফল্য, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও জাতীয়তাবাদ আজও ইতিহাসে আলোচিত। তবে গণতন্ত্রের অভাব, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের কারণে এই দিবস আজ প্রশ্নবিদ্ধ। বর্তমান প্রজন্মের কাছে ১ সেপ্টেম্বর কেবল একটি ঐতিহাসিক দিন—যেখানে মুক্তির স্বপ্ন আর স্বৈরতন্ত্রের দুঃসহ স্মৃতি একসাথে মিশে আছে।