‘হিরো’ থেকে ‘দেশদ্রোহী’
লাদাখে সোনম ওয়াংচুকের যাত্রা
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৩:১৩, ৭ অক্টোবর ২০২৫ | আপডেট: ১৩:২৫, ৭ অক্টোবর ২০২৫

ভারতের হিমালয় ঘেঁষা লাদাখ— এক সময় যাকে দেশজ উদ্ভাবন, শিক্ষার বিকল্প মডেল আর পরিবেশ আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে দেখা হতো, আজ সেই অঞ্চলেই চলছে চরম অস্থিরতা। কেন্দ্রবিরোধী দাবির নেতৃত্ব দিচ্ছেন যিনি, তিনি আর কেউ নন— রামন মাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক।
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের সময় তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। তখন লাদাখকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছিল— যেটি স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দাবি ছিল। কিন্তু আজ, ছয় বছর পর, সেই সিদ্ধান্তই লাদাখবাসীর মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বেলে দিয়েছে। সোনম ওয়াংচুককে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরা একটি বিস্তারিত প্রতিবেদনে এই সব তথ্য জানিয়েছে।
সংবিধানিক অধিকার থেকে দমননীতি পর্যন্ত
লাদাখকে আলাদা করার পরও দিল্লি এখানকার জন্য কোনো বিধানসভা বা গণতান্ত্রিক কাঠামো দেয়নি। ফলে অঞ্চলটি এখন পুরোপুরি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে। ওয়াংচুক ও স্থানীয় কর্মীরা এর বিরোধিতা করে ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত মর্যাদার দাবি তোলেন, যা উপজাতীয় অঞ্চলগুলোকে প্রশাসনিক স্বায়ত্তশাসন দেয়।
২০২৪ ও ২০২৫ সালে তিনি একাধিক অনশন ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করেন। কিন্তু সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে আন্দোলনের মোড় নেয় সহিংসতায়—২৪ সেপ্টেম্বর লেহ শহরে তরুণদের একটি অংশ বিজেপির কার্যালয়ে আগুন লাগায়। নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে চারজন নিহত ও বহু আহত হন। এরপর শুরু হয় ব্যাপক অভিযান— ৮০ জনেরও বেশি আটক হন, যার মধ্যে আছেন ওয়াংচুক নিজেও।
‘দেশদ্রোহ’ ও ‘ষড়যন্ত্র’-এর অভিযোগ
২৬ সেপ্টেম্বর ওয়াংচুককে জাতীয় নিরাপত্তা আইন এর আওতায় গ্রেপ্তার করা হয়— যা অভিযোগ ছাড়াই এক বছর পর্যন্ত কারাবন্দি রাখার সুযোগ দেয়। তাকে লাদাখ থেকে ১ হাজার কিলোমিটার দূরে রাজস্থানের জোধপুর কারাগারে পাঠানো হয়।
পুলিশ দাবি করেছে, তার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড ও সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, তার আন্দোলনে পাকিস্তান-সংযোগের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে— এক পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তার কাছ থেকে ওয়াংচুকের আন্দোলনের ভিডিও ছড়ানো হয়েছিল বলে দাবি করা হয়।
এমনকি, ২০১৮ সালে ইসলামাবাদে জাতিসংঘের সহযোগিতায় অনুষ্ঠিত ডন মিডিয়া গ্রুপের এর জলবায়ু সম্মেলনে তার অংশগ্রহণকেও এখন সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে।
তবে ওয়াংচুকের পরিবার ও সমর্থকরা এসব অভিযোগকে ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধ’ বলে দাবি করেছেন। তার স্ত্রী গিতাঞ্জলি আংমো আল জাজিরাকে বলেন—‘যে সরকার কয়েক মাস আগেও তাকে রাষ্ট্রীয় প্রচারণায় ব্যবহার করেছে, আজ সেই সরকারই তাঁকে ‘দেশদ্রোহী’ বলছে— এটাই প্রমাণ করে তাঁকে ভয় দেখানোই আসল উদ্দেশ্য।’
লাদাখজুড়ে শোক ও ক্ষোভ
অভিযানের পর লেহ-তে কারফিউ জারি করা হয়। শহরজুড়ে সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীর টহল চলছে। বহু নাগরিক ঘরবন্দি অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন।
আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী স্তানজিন দর্জে নামে এক তরুণ ব্যবসায়ী আত্মহত্যা করেন— পরিবার জানায়, ওয়াংচুকের গ্রেপ্তারে তিনি গভীরভাবে ভেঙে পড়েছিলেন।
লাদাখ বৌদ্ধ সংঘের সভাপতি ত্সেরিং দর্জে বলেন, ‘ওয়াংচুক শুধু একজন নেতা নন, তিনি ছিলেন আমাদের প্রেরণা। এখন গোটা লেহ শোকে আচ্ছন্ন।’
‘ফুন্সুখ ওয়াংডু’ থেকে রাষ্ট্রের শত্রু
১৯৬৬ সালে লেহর উলে-টোকপো গ্রামে জন্ম নেওয়া ওয়াংচুক ছোটবেলা থেকেই সৃজনশীল শিক্ষার ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করেন। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন SECMOL (Students’ Educational and Cultural Movement of Ladakh)— যেখানে পরীক্ষায় অকৃতকার্য শিক্ষার্থীরাই ভর্তি হতে পারে। তার শিক্ষা-পদ্ধতিতে হাতেকলমে শেখানো হয় কৃষি, রেডিও, যন্ত্র মেরামতসহ নানা বিষয়। এই উদ্যোগ লাদাখের শিক্ষাব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। পরে তার উদ্ভাবিত আইস স্টুপা বা কৃত্রিম হিমবাহ প্রকল্প তাকে আন্তর্জাতিক খ্যাতি এনে দেয়।
২০১৮ সালে তিনি রামন মাগসেসে পুরস্কার পান। তার জীবন ও চিন্তা থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে বলিউড নির্মাণ করে থ্রি ইডিয়টস চলচ্চিত্রের বিখ্যাত চরিত্র ‘ফুন্সুখ ওয়াংডু’— যাতে অভিনয় করেছিলেন আমির খান।
কিন্তু আজ সেই বাস্তব ‘ওয়াংডু’কে অভিযুক্ত করা হচ্ছে দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে।
‘আগুন থেকে আগুনে’ — ওয়াংচুকের উপলব্ধি
২০১৯ সালে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিলের পর তিনি বলেছিলেন, ‘ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, লাদাখের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পূরণ করার জন্য।’
কিন্তু ২০২৫ সালে অনশনের সময় তিনি বলেন, ‘তখন বুঝিনি— আমরা আগুনের কড়াই থেকে বেরিয়ে আবার আগুনে পড়ে গেছি। আজ লাদাখে গণতন্ত্রের কোনো ফোরাম নেই।’
বিতর্কের মূল কারণ: গণতন্ত্র বনাম নিয়ন্ত্রণ
পর্যবেক্ষকদের মতে, ওয়াংচুকের আন্দোলনকে রাষ্ট্রবিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা আসলে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণনীতির প্রতিফলন।
হিমালয়ের সমাজ ও পরিবেশবিষয়ক গবেষক মানশি আশের বলেন—‘যখন রাষ্ট্র ও কর্পোরেট স্বার্থ একত্রে কেন্দ্রীভূত হয়, তখন স্থানীয় জনগণ ও পরিবেশই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ওয়াংচুকের আন্দোলন টেকসই উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের প্রশ্ন তুলেছে— এটাই মূল সংঘাত।’
জনপ্রিয় প্রতিবাদের নতুন অধ্যায়
লাদাখের জনগণ এখন দুই ভাগে বিভক্ত— কেউ কেউ সহিংসতার জন্য আন্দোলনকারীদের দোষারোপ করছেন, আবার অনেকে বলছেন, ‘এই গ্রেপ্তারই লাদাখের ইতিহাসে নতুন জাগরণের সূচনা।’
ওয়াংচুকের মুক্তির দাবিতে এখনো সামাজিক মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ চলছে — #FreeSonamWangchuk, #StatehoodForLadakh।
তবে সরকার এখনও পর্যন্ত তার মুক্তির কোনো ইঙ্গিত দেয়নি।