নাইরোবির ‘বার্ডম্যান’অদম্য পরিবেশবাদী
আহত পাখিদের উদ্ধার করেন
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:১৭, ৮ অক্টোবর ২০২৫

কেনিয়ার রাজধানী নাইরোবির কেন্দ্রস্থলে হাঁটলে অনেক সময় শোনা যায় এক ডাক— “বার্ডম্যান! বার্ডম্যান!”। রাস্তার দোকানি, পুলিশ, এমনকি পথচারীরাও থেমে তাকান ২৭ বছরের তরুণ রডারস ওলো মাগুথার দিকে। তার মাথা ও কাঁধে বসে থাকে কয়েকটি শিকারি পাখি— কাইট, পায়রা বা আহত কাক। কেউ হাসে, কেউ ভয় পায়, কেউ আবার ছবি তোলে। রাস্তার জীবনের প্রতীক হয়ে উঠেছেন এই ‘নাইরোবি বার্ডম্যান’।
মাগুথা বহু বছর ধরে নাইরোবির রাস্তায় বসবাস করছেন। একসময় তিনিও ছিলেন সেই পথশিশুদের একজন, যারা শহরের ব্যস্ত মোড়ে হাত পেতে দাঁড়ায়। কিন্তু তাকে আলাদা করেছে তার পাখিদের প্রতি অদ্ভুত ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ।
“মানুষ আমাদের ভয় পায়, ফোন লুকিয়ে নেয়,” বলেন মাগুথা। “কিন্তু যখন তারা পাখিগুলো দেখে, সব বদলে যায়। রাগী মুখে হাসি ফিরে আসে।”
মাগুথার জন্ম নাকুরু শহরে, যেখানে বিখ্যাত লেক নাকুরু ন্যাশনাল পার্কে ভিড় জমায় হাজার হাজার ফ্লেমিঙ্গো। ছোটবেলায় তিনি চুপিচুপি পার্কে ঢুকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পাখি দেখতেন। অন্য বাচ্চারা যেখানে গুলতি দিয়ে পাখি মেরে আনন্দ পেত, তিনি সেগুলো রক্ষা করতে শেখাতেন। বাড়িতে লালন করতেন কবুতর, হাঁস, এমনকি একবার একটি আহত ফ্লেমিঙ্গোকেও।
কিন্তু ১৩ বছর বয়সে মায়ের মৃত্যু তাকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়। এক শহর থেকে আরেক শহরে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে অবশেষে তিনি আশ্রয় নেন নাইরোবির রাস্তায়। সেখানেই গড়ে ওঠে তার ‘স্ট্রিট ফ্যামিলি’— একদল শিশু ও যুবক, যারা একে অন্যের ভরসা।
আঘাতপ্রাপ্ত পাখিদের রক্ষক
চার বছর আগে মাগুথার জীবনে আসে এক পরিবর্তন। একদিন মোই অ্যাভিনিউয়ের গাছের নিচে বসে খাওয়ার সময় তিনি দেখতে পান আহত একটি ব্ল্যাক কাইট মাটিতে পড়ে আছে। পাখিটি তার দিকে এগিয়ে আসে, খাবার নেয়, তারপর তাঁর হাতের ওপর উঠে বসে। তিনি নাম দেন ‘জনসন’— তখনকার নাইরোবি গভর্নরের নামে।
এরপর থেকে তিনি অসংখ্য আহত পাখি উদ্ধার করেছেন— কাক, পায়রা, পেঁচা, এমনকি ভাঙা ডানার একটি মারাবু স্টর্কও। নিজের ভাষায়, “তারা আমাকে খুঁজে নেয়, আমি নয়।”
কিন্তু নাইরোবি এখন দ্রুত হারাচ্ছে তার সবুজ বৃক্ষরাজি। নতুন রাস্তা ও অফিস ভবনের জন্য গাছ কাটা হচ্ছে, ফলে নষ্ট হচ্ছে পাখিদের বাসা। “প্রতিটি কাটা গাছে নীড় ভাঙে, ছানাগুলো মাটিতে পড়ে যায়,” বলেন তিনি। “তখন আমি গিয়ে তাদের তুলে আনি।”
২০২৪ সালের জুনে কেনিয়ার তরুণরা যখন সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামে, তখন মাগুথাও যোগ দেন। তার মাথায় জনসন ও কাঁধে আরও দুই পাখি— জেমি ও জ্যানি। মুহূর্তেই ভিড় তাকে ঘিরে ধরে, সাংবাদিকরা ছবি তোলে, আর পুলিশ তাকে “নেতা” ভেবে লাঠিপেটা করে। এক রাবার বুলেট লাগে তাঁর মাথায়, যা তাঁর দৃষ্টিশক্তিতে স্থায়ী ক্ষতি করেছে।
তারপর থেকেই তিনি কেনিয়ার তরুণ সমাজে প্রতিরোধ ও আশার প্রতীক হয়ে উঠেছেন।
ভাইরাল খ্যাতি তাকে ধনী করেনি। এখন তিনি নাইরোবির উপকণ্ঠে কায়োলে এলাকার এক সদয় ব্যক্তির ঘরে থাকেন। দিনে প্লাস্টিক বাছাই করে মাত্র ২ ডলার রোজগার করেন, আর সময় পেলেই ভিডিও তৈরি করে ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকে পাখি ও পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা ছড়ান।
তার স্বপ্ন— একদিন এমন একটি আশ্রয়কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখানে রাস্তার শিশু ও আহত পাখি দুজনই আশ্রয় পাবে।
“পাখি আর মানুষ— দুজনেই সাহায্য চায়, ভালোবাসা চায়,” বলেন তিনি।“ভালোবাসা দিলে তারা উড়ে যায়, আবার ফিরে আসে— ঠিক যেমন আমি এখনো আশা করি, কোনো একদিন আমিও উদ্ধার হব।”সূত্র :