তালেবান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর
কী আলোচনায় থাকছে, কেন তা গুরুত্বপূর্ণ
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রকাশ: ১২:৫৯, ৯ অক্টোবর ২০২৫

ছবি : আফনাস্তিান টাইমস
জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বিশেষ অনুমতি পেয়ে প্রথমবারের মতো ভারতে পৌঁছেছেন আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাওলাভি আমির খান মুততকি। বুধবার (৮ অক্টোবর) তিনি নয়াদিল্লিতে পৌঁছান সপ্তাহব্যাপী সরকারি সফরে। এ সফরকে আফগানিস্তানের নতুন শাসনব্যবস্থা ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক পুনর্গঠনের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে দেখা হচ্ছে।
মুততকির এই সফর সম্ভব হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের তালেবান নিষেধাজ্ঞা কমিটির বিশেষ ছাড়ের ফলে। কমিটি ৩০ সেপ্টেম্বর তার ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে সফরের অনুমতি দেয়। নয়াদিল্লি বিমানবন্দরে মুততকিকে স্বাগত জানান ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রন্ধির জয়সওয়াল। তিনি এক্স (সাবেক টুইটার)-এ লিখেছেন, “আমরা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও আঞ্চলিক বিষয় নিয়ে ফলপ্রসূ আলোচনার অপেক্ষায় আছি।”
ভারত সফরের এজেন্ডায় কী রয়েছে
তালেবান শাসন গ্রহণের পর এই প্রথম কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের সফর ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে হচ্ছে। সফরের সময় মুততকি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর এবং জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল-এর সঙ্গে বৈঠক করবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। আলোচনায় থাকবে—বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, মানবিক সহায়তা এবং অবকাঠামোগত সহযোগিতা,আঞ্চলিক নিরাপত্তা ও সন্ত্রাসবিরোধী উদ্যোগে সমন্বয় এবং দ্বিপাক্ষিক কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনর্গঠনের সম্ভাবনা।
ভারতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকা সত্ত্বেও এই উচ্চপর্যায়ের সংলাপকে দুই দেশের সম্পর্কের বাস্তববাদী পুনর্মূল্যায়ন হিসেবে দেখা হচ্ছে। মুততকির সফরে আরও রয়েছে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা ও আগ্রার ঐতিহাসিক তাজমহল পরিদর্শনের কর্মসূচি। এছাড়া তিনি ভারতে অবস্থানরত আফগান ব্যবসায়ী ও প্রবাসী সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও দেখা করবেন।
কেন এই সফর গুরুত্বপূর্ণ
এই সফর তালেবান সরকারের জন্য এক ধরনের কূটনৈতিক সাফল্য।
প্রথমত, এটি তাদের আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ভাঙার সুযোগ দিচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ভারতের মতো আঞ্চলিক শক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ তাদের বৈধতা অর্জনের পথে বড় পদক্ষেপ।
তৃতীয়ত, পাকিস্তান ও চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আঞ্চলিক ভারসাম্য রক্ষার কৌশল হিসেবেও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত গত দুই দশকে আফগানিস্তানে ৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি উন্নয়ন সহায়তা দিয়েছে। ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর ভারত কূটনৈতিকভাবে দূরে থাকলেও সাম্প্রতিক সময়ে মানবিক সহায়তা ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা আলোচনায় আবার সক্রিয় হচ্ছে।
ভারতের প্রধান লক্ষ্য হলো— আফগান ভূখণ্ড যেন কোনোভাবেই ভারতবিরোধী সন্ত্রাসবাদের ঘাঁটি না হয়।
পাশাপাশি, চীন-পাকিস্তান প্রভাববলয়ের বাইরে থেকে দক্ষিণ এশীয় ভারসাম্য রক্ষা করাও ভারতের কৌশলগত অগ্রাধিকার।
এই সফর তাই নয়াদিল্লির বাস্তববাদী কূটনীতি ও ‘রিস্ক ম্যানেজমেন্ট’-এর অংশ বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।
আমির খান মুততকি ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞার আওতায় আছেন, যার মধ্যে রয়েছে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা, সম্পদ জব্দ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা। তবে এবার পাকিস্তানের সভাপতিত্বে থাকা তালেবান স্যাংশনস কমিটি তাঁর ভ্রমণের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়েছে। এই ছাড়ই ভারতের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের পথ খুলে দিয়েছে।
যদিও ভারত এখনো তালেবান সরকারকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয়নি, তবুও এই সফর স্পষ্ট করে যে নয়াদিল্লি কূটনৈতিকভাবে ‘যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার’ নীতি থেকে সরে এসে বাস্তবসম্মত সম্পৃক্ততার দিকে এগোচ্ছে।
ভারত সফরে মুততকির আলোচনায় মানবিক সহায়তা, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা প্রধান বিষয় হলেও এর প্রভাব অনেক গভীর। আফগানিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ, দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতি এবং ভারত-পাকিস্তান কৌশলগত প্রতিযোগিতার নতুন অধ্যায় এই সফরের মধ্য দিয়েই শুরু হতে পারে।
বিশ্লেষকদের মতে, “এটি কেবল একটি সফর নয়— বরং এক নতুন ভূরাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, যেখানে নীতির চেয়ে বাস্তবতাই কূটনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে।”সূত্র হিন্দুস্তান টাইমস