‘দেশ স্বাধীন করলেও চৌকিদারের কাছেও দাম পাই না’
মো. রমিজ উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা
প্রকাশ: ২২:৩৩, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রমিজ উদ্দিন। গ্রাফিক্স : সমাজকাল
যখন হুনি (শুনি), কুমিল্লার একটা গার্লস স্কুলে, নাম মনে নাই; সেখানে মেয়েদের অত্যাচার করা হইতেছে, তখনই আমি যুদ্ধে যাওনের সিদ্ধান্ত নিই।
অত্যাচার সহ্য করতে না পাইরা মেয়েরা ওড়না ও কোমরের কাইতন প্যাচাইয়া মরছে। এইডা হুনার পর আমার মনে হইলো, কী মুসলমান আমরা? একজন মুসলমান হইয়া আরেকজন মুসলমানের মেয়েদের বাড়ি থেকে ধরে ধরে নিয়া অত্যাচার করতাছে। এইডা মানতে পারতেছিলাম না।
বঙ্গবন্ধু ডাক দিছেন, সাড়া দিয়া সবাই মুক্তিযুদ্ধে গেছেন। আমারেও যুদ্ধে যাইতে হইবো। তখন আমার পাশের বাড়ির একজন, নাম তমিজ উদ্দিন। তারে সঙ্গে লইয়া সোনাইমুড়ি যাই। আল্লাহ যা করার করব, দেশের জন্য মরলে মইরাম।
সোনাইমুড়ি থেকে ভারতের উদয়পুর যাই। উদয়পুর থেকে পালাটান ক্যাম্পে পাঠাইয়া দেয়। তখন আষাঢ় মাস। ওইখানে তিন মাস ট্রেইনিং করি। ভারত থেকে ট্রেইনিং নিয়া ভাদ্র মাসে দেশে ফিরা আই (আসি)। তহন চারদিকে পানি থৈ থৈ করছিলো। চান্দিনায় ১২০ জনের একটা দল পাঠানো হয়। সেই দলের একজন সদস্য আমি।
আমরা তখন থেইক্কাই যুদ্ধের মাঠে। শত্রুর মোকাবেলায় সবসময় প্রস্তুত থাকতাম। রামমোহন রোডের আড়ংয়ে যুদ্ধ করছি, পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। মাধাইয়াও মেইন রোডেও যুদ্ধ করতে হইছে। সবচেয়ে বড় যুদ্ধটা করছি আমরা, বল্লাচর। ওইখানে আমাদের চাইরজন মুক্তিযোদ্ধা মারা গেছিলো। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বহু সৈন্য ওই এলাকায় নাইম্মা আইছিলো। ওই লড়াইয়ে ১৪১৭ জনের মতন পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্য আমাদের কাছে সারেন্ডার করতে বাধ্য হইছিলো। তাদের অনেক সৈন্যও মারা গেছিল। কারণ, তারা তো আওবাও জানত না। তাই তাগোরে হারাইতে পারছি।
যুদ্ধে বড় কোনো ক্ষতি হয় নাই আমার। তবে ক্ষতির মুখে পড়ছিলাম। বল্লারচর লড়াইয়ের সময়। পাকিস্তানি বাহিনীর সামনে পইড়া গেছিলাম। হাতে অস্ত্র নাই। অস্ত্র হইলো তিনডা। দুই কমান্ডারের কাছে দুইডা। তাদের বাড়ি দূরে আছিলো। কাজী জোড়পুকুরিয়া। দূর থেইক্কা লড়াইয়ের চেষ্টা করছিলাম। সহমুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর কাছাকাছি যেতে না করছিলাম বারবার। অনেক সামনে চলে গেছিল। তখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাশফায়ার করা শুরু করে। ধানক্ষেতের মধ্যে পইড়া তখন অনেকেই বাইচ্চা আইছে।
পরেরদিন আমরা আবারও অস্ত্র পাইছি। আমি পাকিস্তান আমলে আনসার ট্রেইনিং দিছিলাম। কিছু জানা আছিল বিধায় বাইচ্চা আসতে পারছিলাম।
পাকিস্তানি বাহিনীর সদস্যদের আমাদের এখানকার রাজাকাররা সাহায্য করছিল। তবে আমাদের সামনে এসে কোনো ক্ষতি করার চেষ্টা করে নাই। সেই সাহাস করে নাই। রাজাকারদের আমরা যেকোনো সময় শেষ করতে পারতাম, কিন্তু আমাদের সেই সুযোগ দেওয়া হয় নাই। চান্দিনার বিভিন্ন জায়গায় আমরা যুদ্ধ করছি। লুকাইয়া থাকতে হইতো আমাদের। অনেক কষ্ট। অনেক দুঃখের ইতিহাস। কয়ডা বলবো।
১২ ডিসেম্বর চান্দিনা মুক্ত হইছিলো। চান্দিনা শত্রুমুক্ত হওয়ার পর নিজ এলাকায় ছিলাম। কখন আমরা জিতব, কখন জয়ের খবর পাইবো-সেই অপেক্ষা করছিলাম। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী আত্মসমর্পণ করলেও ওই দিন আমরা দেশ স্বাধীনের কথা শুনতে পারি নাই। পরে হুনছি। রেডিওতে। স্বাধীনের খবর পাই, তখন ভেতরে এমন একটা আনন্দ লাগছে যে, দুশমনের হাত থেইক্কা আল্লাহ আমাদের রক্ষা করছে। তাদের হাত থেইক্কা যে আমরা বাইচ্চা গেছি।
সবাই বলাবলি করছিলো, দেশ স্বাধীন হইছে। দেশ মুক্ত হইছে। যারা স্বাধীনের বিরুদ্ধে ছিলো, তারাও তখন মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে আইসা গেছিল। স্বাধীনের পর সবাই বঙ্গবন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছিলো। তার ডাকে সাড়া দিয়েই তো আমরা যুদ্ধ করছি। দেশ স্বাধীন হইছে।
দেশ স্বাধীনের পর যেভাবে দেশটা লুট হইছে, অধঃপতনের দিকে নিয়া গেছে। দুঃখ লাগে। এমনটা তো হওয়ার কথা আছিলো না। এইডা তো কোনোভাবে কাম্য না। তখন কথা আছিলো অধিকার। যার যেই অধিকার, সে মতন চলব। অধিকার মতন ভোট দিব। সব তো কাইড়া নিলো। আর যারা দেশ স্বাধীনের বিরোধিতা করছিলো, তাদের রাজনৈতিক অধিকার থাকা উচিত না। আমি যদি কই তারা রাজনীতি করতে পারব না, আমি তো এহন তাগো প্রতিরোধ করতে পারুম না।
মুক্তিযোদ্ধারা যে সম্মান পাওনের কথা আছিল, হেইডা পায় নাই। পয়সাডা বড় কথা না। মর্যাদাডা বড়। আমরা দেশ স্বাধীন করছি ঠিক। কিন্তু বোর্ড অফিসে (ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়) গেলে একজন চৌকিদারের কাছেও দাম পাইছি না। গিয়া খে-রই (দাঁড়িয়ে) থাকছি। চেয়ারম্যান সার্টিফিকেটের জন্য গেলেও খে-রই থাহন লাগছে। পয়সা দিয়া আনন লাগছে একটা সার্টিফিকেট। এহনো পয়সা ছাড়া হয় না চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট। স্বাধীনতার অর্থ তো এইডা না।
রাষ্ট্রে আল্লাহ এমন একজনকে পরিচালনা হিসেবে দেক, যাতে তিনি দেশটাকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারেন। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারেন। যে যে ধর্ম পালন করেন, তা যেন করতে পারে। যাতে কোনো বাধা না আইয়ে। আমাগো নবীও বলে গেছেন, অন্য ধর্মের ওপর আঘাত কইরো না। কারও ধর্মের ওপর কেউ আঘাত কইরো না। পারলে নিজের ধর্মের দিকে বুঝাইয়া আনো। কিন্তু কারও ওপর জুলুম কইরো না। এমন লোকজন যেন আল্লাহ ব্যবস্থা কইরা দেন। মানুষ যেন শান্তিতে থাকে।
পরিচিতি : মো. রমিজ উদ্দিন। সনদপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহিচাইল, চান্দিনা। কুমিল্লা।
