তারেক রহমানের ফেরা-না ফেরা
হাবীব ইমন
প্রকাশ: ০০:৪৮, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। ছবি: সংগৃহীত
তারেক রহমানের দেশে ফেরা-না ফেরা নিয়ে আলোচনা বিএনপির দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সংকটকে নতুন করে প্রকাশ্যে এনেছে।
বিএনপি বহু বছর ধরে মূলত দুই ব্যক্তির উপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছে—বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমান। খালেদা জিয়া রাজনৈতিকভাবে অসুস্থ এবং কার্যত নিষ্ক্রিয়, আর তারেক লন্ডন থেকে দূরনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এই অবস্থায় বিকল্প কোনো কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গড়ে ওঠেনি। ফলে দলের সামনে এক অভূতপূর্ব অস্থিরতা, বিভ্রান্তি ও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।
তারেকের এই সিদ্ধান্ত রাজনৈতিকভাবে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে। বিদেশে বসে দল পরিচালনা কার্যকর নয়, এটি স্বীকার করে তিনি নিজেও দলের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরেছেন। তার আইনি জটিলতা, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং রাজনৈতিক আশ্রয়ের সমস্যাগুলো মিলিয়ে এই বার্তা স্পষ্ট যে, দেশে ফিরে স্বশরীরে উপস্থিত থেকে দলের প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। আবার তার এই অনুপস্থিতি বিএনপিকে আরও দুর্বল অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। দলের অন্য কেউ স্থায়ী নেতৃত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়নি, নতুন প্রজন্মের নেতারা তৃণমূল পর্যায়ে সশক্ত হতে পারেনি।
বিগত এক দশকে বিএনপিতে কোনো কেন্দ্রীয় কাউন্সিল আয়োজন হয়নি। তৃণমূলের মতামত নেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। হঠাৎ করে কখনো কখনো একেক নেতাকে সাময়িকভাবে সামনে আনা হলেও, কেউ স্থায়ীভাবে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের দায়িত্ব নিতে পারেননি। সব সিদ্ধান্ত—প্রার্থী মনোনয়ন থেকে আন্দোলন কৌশল—লন্ডনভিত্তিক হয়ে গেছে। এই দূরনিয়ন্ত্রণ রাজনীতি দলের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের সংকট সৃষ্টি করেছে।
অনেকেই মনে করেন, খালেদা জিয়া থেকে তারেক রহমান পর্যন্ত নেতৃত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে দুর্বল করেছে।
দলের ভেতরের অস্থিতিশীলতা তৃণমূল পর্যায়ে ধীরে ধীরে প্রকাশ পেতে শুরু করেছে। স্থানীয় নেতাদের মধ্যে কোন্দল, মনোনয়ন নিয়ে ক্ষোভ, এবং দলীয় সংঘাত— সব মিলিয়ে বিএনপিতে অস্থিরতা বাড়ছে। যে দল বহু বছর ধরে ‘গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা’–এর কথা বলেছে, তাদের নিজেদের ভেতর গণতন্ত্র ও স্বচ্ছ নেতৃত্ব কাঠামোর অভাব অত্যন্ত প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। তরুণ প্রজন্ম মাঠে আন্দোলন করলেও, তারা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে স্থান পাচ্ছে না। মেধাবী নেতারা উপেক্ষায় বা কোন্দলে দূরে সরে যাচ্ছেন। এই অবস্থায় দলটি এমন এক সময়ের মুখোমুখি, যেখানে নেতৃত্বসংকট শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যতেও দলের জন্য গভীর চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক বাস্তবতাও বিএনপির অবস্থাকে আরও জটিল করছে। মিয়ানমার, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা—সব মিলিয়ে অঞ্চলে নতুন একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি হচ্ছে। বড় রাজনৈতিক দলগুলোই প্রজন্ম পরিবর্তনের চাপের মধ্যে আছে। আওয়ামী লীগে সম্ভাব্য উত্তরসূরির আলোচনা যেমন হচ্ছে, বিএনপিতেও জুবাইদা রহমান বা ভবিষ্যতে জাইমা রহমানকে ঘিরে সম্ভাব্য নেতৃত্বের কথা বলা হচ্ছে। তবে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, এটি কি সত্যিকারের দলীয় গণতন্ত্রের ফল, নাকি আবারও পারিবারিক উত্তরাধিকার।
এদিকে গণ-অভ্যুত্থানের পর উদ্ভূত নতুন রাজনৈতিক শক্তি এনসিপি সাংগঠনিক দুর্বলতার মধ্যে রয়েছে। তবে তারা পরিবারভিত্তিক রাজনীতি না করে দীর্ঘমেয়াদে সংগঠনের ভিত্তি গড়ার সুযোগ রাখছে। বিএনপি সেই সুযোগটি হারিয়েছে। তারেক রহমানের দেশে ফেরা-না ফেরার সিদ্ধান্ত দলের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটিকেই সামনে নিয়ে এসেছে। কোনো কার্যকর দ্বিতীয় সারির নেতৃত্ব নেই, দলীয় গণতন্ত্র নেই, ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির পরিকল্পনা নেই। এই ব্যর্থতা যতদিন থাকবে, বিএনপি শুধু রাজনৈতিক মাঠেই নয়, দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যতেও পিছিয়ে থাকবে।
এখন প্রশ্ন একটাই—বিএনপি কি সত্যিই নতুন নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারবে, নাকি নিজেদের তৈরি সংকটেই আটকে থাকবে?
