গাজায় শিশুর কাঁধে জীবিকার ভার
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ২৩:৪২, ১ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ২৩:৪৫, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
মুহাম্মদ আশুর কফি বিক্রি করছে। ছবি: আল-জাজিরা
গাজা সিটির রাস্তায় ফ্লাস্ক হাতে কিশোর মুহাম্মদ আশুর কফি বিক্রি করছে। পনেরো বছর বয়সী মুহাম্মদ আশুরের এখন স্কুলে থাকার কথা ছিল। কিন্তু গাজায় ইসরায়েলের আগ্রাসনে তার বাবা নিহত হওয়ায় সে পড়াশোনা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে এবং পরিবারের রুটি-রুজির দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিতে হয়েছে।
এই কফি বিক্রেতা আল-জাজিরাকে জানায়, ‘এই বোঝা আমার বহন করার কথা ছিল না। ফ্লাস্ক, কাপ বহন করা, বারবার যাওয়া-আসা করা, এটা আমার জন্য কষ্টকর। আমি ক্লান্ত, কিন্তু আমার ভাই-বোনদের ভরণপোষণ করতে হবে, তাই আমাকে এটা করতেই হয়।’
ইসরায়েলের যুদ্ধের ফলস্বরূপ গাজায় কাজ করতে বাধ্য হওয়া ফিলিস্তিনি শিশুদের ক্রমবর্ধমান সংখ্যার মধ্যে মুহাম্মদ একজন। এই যুদ্ধে কমপক্ষে ৩৯ হাজার শিশু তাদের এক বা উভয় অভিভাবককে হারিয়েছে। সংঘাতের কারণে গাজার অর্থনীতি বিপর্যস্ত হওয়ায় আট বছর বয়সের মতো ছোট শিশুরাও তাদের পরিবারের বেঁচে থাকার জন্য কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। এর ফলে তারা শুধু তাদের শিক্ষাই হারাচ্ছে না, তাদের শৈশবও হারাচ্ছে।
মুহাম্মদের মা আতাদ আশুর বলেন, তিনি জানেন তার ছেলের স্কুলে থাকা উচিত, কিন্তু তাদের সামনে অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
তিনি বলেন, ‘তার বাবা নিহত হওয়ার পর আমাদের কোনো রোজগারই ছিল না।’
তিনি আরও জানান, মুহাম্মদের বড় ভাইয়েরা কোনো কাজ খুঁজে পাচ্ছে না এবং তিনি নিজেও পরিবারের জন্য কিছু জোগাড় করতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘সে এখনও শিশু, কিন্তু এমন একটি দায়িত্ব বহন করছে যা তার নয়। পরিস্থিতিই আমাদের এর মধ্যে ঠেলে দিয়েছে।’
গাজার সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, শিশুদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে এবং এটা তাদের এমন অতিরিক্ত দায়িত্বে বাধ্য করছে, যা সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের করার কথা।
ইউনিসেফের মুখপাত্র টেস ইনগ্রাম বলেন, ‘আমরা দেখছি আরও বেশি সংখ্যক শিশু আবর্জনা ঘেঁটে জ্বালানির কাঠ খুঁজছে বিক্রির জন্য, শিশুরা কফি বিক্রি করছে।’
তিনি বলেন, ‘সংস্থাটি অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে এই নেতিবাচক সঙ্কট মোকাবিলার প্রক্রিয়াগুলো থামানোর জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করতে, যার মধ্যে পরিবারগুলোকে নগদ সহায়তা দেওয়া, শিশুশ্রমের ঝুঁকি সম্পর্কে তাদের সচেতন করা এবং পরিবারগুলোকে পুনরায় কর্মসংস্থান শুরু করতে সাহায্য করা।’
অধিকৃত পশ্চিম তীরের রামাল্লা থেকে সেভ দ্য চিলড্রেনের গাজা মানবিক পরিচালক কামিংস বলেন, ‘যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট পারিবারিক ভাঙনও শিশুদের ভাই-বোন বা বয়স্ক পারিবারিক সদস্যদের দেখাশোনা করার ভূমিকায় ঠেলে দিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গাজার পুরো পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়েছে এবং শিশুরা অত্যন্ত অরক্ষিত। এই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি সত্যিই তাদের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।’
এই যুদ্ধের প্রভাব গাজার শিশুদের ওপর কতটা ভয়াবহ, তার পরিসংখ্যান একটি চিত্র তুলে ধরে। গাজার জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই ১৮ বছরের নিচে। সেভ দ্য চিলড্রেনের তথ্য অনুসারে, ৬ লাখ ৬০ হাজারেরও বেশি শিশু আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং আনুমানিক ১ লাখ ৩২ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টির ঝুঁকিতে রয়েছে।
গাজা সিটি থেকে আল-জাজিরার হিন্দ খাওদারি জানান, রুটি-রুজির সংস্থানকারী অভিভাবকদের হারানোর কারণে গাজার শিশুরা তাদের করার কথা নয় এমন কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘তাদের স্কুলে থাকার কথা ছিল, বন্ধুদের সঙ্গে খেলার কথা ছিল। ফিলিস্তিনি শিশুদের ওপর যুদ্ধের প্রভাব বিশাল।’
পরিবারের জন্য অর্থ উপার্জন করে আরেকটি দীর্ঘ দিন শেষে মুহাম্মদ যখন হেঁটে বাড়ির দিকে ফেরে, তখন সে একটি স্কুলের পাশ দিয়ে যায় এবং মনে মনে আকাঙ্ক্ষা করে, সে এখনও ছাত্র থাকলে ভালো হতো। সে বলে, ‘আমার বাবা বেঁচে থাকলে, আপনি আমাকে স্কুলে যেতে দেখতেন।’
