বন্যায় ভেসে যাওয়া তাঁবুতে অনাগত সন্তানের অপেক্ষা
মাইসারা জান্নাত
প্রকাশ: ০০:৩৫, ২ ডিসেম্বর ২০২৫
আবদুর রহমান-সামার দম্পতির সঙ্গে তাদের তিন সন্তান। ছবি: আল-জাজিরা
যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় প্রকৃতির রুদ্র রূপ যেন নতুন করে বিপর্যয়ের সৃষ্টি করেছে। ইসরায়েলের ভয়াবহ সামরিক পদক্ষেপের কারণে বাস্তুচ্যুত দম্পতি আবদুর রহমান ও সামারের জন্য এই বছরের প্রথম প্রবল বৃষ্টি আশীর্বাদ হয়ে আসেনি। বরং তা এক নতুন দুর্ভোগের বার্তা নিয়ে এসেছে। তাঁবুর অস্থায়ী আশ্রয়ে শীতের আগমনে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে তারা। অনাগত সন্তানের জন্য সমস্ত প্রস্তুতিই বন্যায় ভেসে গেছে, যেন এক বুক আশা মুহূর্তের মধ্যে কাদায় মিশে গেছে।

তাঁবু বন্যায় ভেসে গেছে। ছবি: আল-জাজিরা
এই কঠিন পরিস্থিতিতে গাজার দাইর আল-বালাহ ক্যাম্পে এই দম্পতি জীবনধারণের সংগ্রামে লিপ্ত, যেখানে প্রতিটি মুহূর্তই অনিশ্চয়তা ও কষ্টের ভারে জর্জরিত। এই করুণ কাহিনি যুদ্ধপীড়িত মানুষের জীবনের এক নির্মম প্রতিচ্ছবি।
তাদের এই করুণ অভিজ্ঞতার সূচনা হয় শীতকালের প্রথম ভারী বৃষ্টিতে। ভোররাতে পানির প্রবল ধারা তাঁবুর জীর্ণ কাঠামো ভেদ করে ভেতরে আছড়ে পড়ে। নিমেষে তাঁবুর নিচের মাটি কাদা পানিতে ঢেকে যায়, যা তাদের ঘুমন্ত অবস্থা থেকে জাগিয়ে তোলে। চারিদিকে গৃহহীন মানুষেরা তখন ছোটাছুটি করছে। বন্যায় নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিসপত্র উদ্ধারের চেষ্টা করছে, জমে যাওয়া কাদা পানি সরিয়ে বালি দিয়ে গর্ত ভরাটের চেষ্টা করছে। এরপর ভিজে যাওয়া বিছানাপত্র শীতের রোদে শুকানোর চেষ্টা করছে।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী সামারের জন্য এই সময়টা আরও বেশি কঠিন। তার প্রসবের সময় আসন্ন, আর নতুন অতিথির জন্য তিনি যা যা তৈরি করে রেখেছিলেন সব ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। কাদা মাটিতে মাখা ছোট ছোট জামাকাপড় দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘বাচ্চার সব জামাকাপড় কাদায় ভিজে গেছে। যা যা জোগাড় করেছিলাম, ডায়াপার এমনকি দুধের কৌটো পর্যন্ত পানির নিচে ডুবে গিয়েছে।’

অনাগত সন্তানের জন্য জোগাড় করা ডায়াপার বন্যার পানিতে ভিজে গেছে। ছবি: আল-জাজিরা
সামার, তার স্বামী আবদুর রহমান এবং তাদের তিন সন্তান গাজা শহরের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের তাল আল-হাওয়া এলাকার বাড়িঘর ছেড়ে দাইর আল-বালাহ ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছেন। ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের কারণে তারা বাস্তুচ্যুত।
নিজের দুর্দশা বর্ণনা করতে গিয়ে সামারের কণ্ঠ প্রায় রুদ্ধ হয়ে আসে। তিনি বলেন, ‘এই মুহূর্তে আমার মনের অবস্থা বোঝানোর মতো ভাষা নেই। মনে হচ্ছে যেন আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেবে। আমি কীভাবে আমার শিশুকন্যাকে এমন পরিস্থিতিতে বরণ করে নেব?’
যখন সামার পোশাক ও কম্বল বাঁচানোর চেষ্টা করছেন, তার স্বামী ও ভাইয়েরা তখন তাঁবুর ভেতরে জমে যাওয়া পানি সরানোর জন্য বালি ফেলছেন। তোষক, কাপড় এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, সবই ভেজা এবং ব্যবহারের অযোগ্য।
সামার বুঝে উঠতে পারছেন না, তিনি ছোট ছোট শিশুদের যত্ন নেবেন, যাদের কাপড় কাদা-বালিতে মাখা, নাকি ভিজে যাওয়া তোষকগুলো শুকানোর চেষ্টা করবেন, নাকি প্রসবের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করবেন।
তিনি বলেন, ‘একটি তাঁবু কোনো সমাধান হতে পারে না। গ্রীষ্মকালে অসহ্য গরম, আর শীতে আমরা বন্যায় ভেসে যাই। এটা কোনো জীবন হতে পারে না।’

আবদুর রহমান বন্যার পানি বালতি দিয়ে অন্যত্র ফেলে দিচ্ছেন। ছবি: আল-জাজিরা
আবদুর রহমান একজন বাবা হিসেবে যে কতটা অসহায়, তা তার কথায় স্পষ্ট। তিনি বলেন, ‘আমি একদিক দিয়ে আমাদের জীবন ধরে রাখার চেষ্টা করি, কিন্তু অন্যদিক থেকে তা ভেঙে পড়ে। যুদ্ধ চলাকালীন এবং এর পরেও আমাদের জীবনটা এমনই।’
আবদুর রহমান জানান, তিনি যখন নাপিতের দোকানে কাজের জন্য যাচ্ছিলেন, তখনই সামার তাকে ফোন করেন। সে কাঁদছিল আর চিৎকার করছিল। সে আমাকে বলল, ‘তাড়াতাড়ি আসো, বৃষ্টির পানি চারদিক থেকে আমাদের তাঁবুতে ঢুকে পড়েছে।’ তিনি ছুটে এসে দেখেন তাঁবুটা সম্পূর্ণরূপে পানিতে ভরে গিয়েছে।
আবদুর রহমান বলেন, নতুন অতিথির জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জোগাড় করতে গিয়ে তিনি বিশাল কষ্টের সম্মুখীন হচ্ছেন। যে ডায়াপার আগে অল্প দামে কিনতেন, সেটাই এখন চড়া দামে কিনতে হচ্ছে। আর সন্তানের জন্য তিনি যা যা তৈরি করেছিলেন, সবই নষ্ট হয়ে গেছে।
সবচেয়ে বড় ভয়ের বিষয় হলো, এই করুণ পরিবেশে নতুন অতিথিকে স্বাগত জানানো।
সামার বলেন, ‘আমি কখনো ভাবিনি যে, আমরা যে মেয়ের স্বপ্ন দেখেছিলাম, তাকে এমন পরিস্থিতিতে বরণ করে নিতে হবে।’
তাদের তিন শিশু নানা অসুস্থতার শিকার। আবদুর রহমান বলেন, ‘বড় ছেলে ঘুমাতে পারছিল না। কোনো কম্বলই নেই।’
এই দম্পতির প্রধান দাবি হলো, শুধু একটি জিনিস পেতে চায়, মর্যাদা। সামার মানবিক সংস্থাগুলোর কাছে তার আবেদন জানান, ‘আমাদের কাপড়, তোষক, কম্বল দরকার। সবকিছু নষ্ট হয়ে গেছে। আমাদের আশ্রয়ের জন্য একটি জায়গা দরকার। একটি প্লাস্টিকের চাদরের ওপর এভাবে বেঁচে থাকা অসম্ভব।’
