নাসরিন আক্তারের দুটি অণুগল্প
নাসরিন আক্তার
প্রকাশ: ১৯:২৬, ১ ডিসেম্বর ২০২৫ | আপডেট: ১৯:২৯, ১ ডিসেম্বর ২০২৫
নাসরিন আক্তার
লাল পিঁপড়ে
বেলা বাড়ার সাথে সাথে লাল পিঁপড়ের সারিটা দলে ভারি হচ্ছে, কি করে যে ওরা গন্ধ পেয়ে যায়! যে রহিমা ওদের পা দিয়ে পিষে মারতো, চুলা থেকে গরম ছাঁই তুলে পথ আটকাতো, আজ তারই শরীরের গন্ধে ওরা ছুটে চলেছে প্রতিশোধের নেশায়। পেট পুরে খাবে আজ, কুরে কুরে খাবে রহিমার চামড়ার নিচে জমে থাকা চর্বিটুকু। আহা! কি আনন্দ।
ছখিনা বিবির কোলে অনবরত কেঁদেই চলেছে দেড় বছরের শিশু হাতেম। বারবার বায়না করছে মার কাছে যাবার, কিছুই খাওয়াতে পারছে না। ঘ্যানঘ্যান করেই চলেছে দাদির কোলে চড়ে। পাশের বাড়ির রহিমদ্দীর বউ এসে দরজায় দাঁড়ায়,
—চাচিআম্মা হাতেম কাঁন্দে ক্যা? হের মায় কই?
ছখিনা বিবি ঘরের কোণে জড়ো করে রাখা খড়ের গাদাটা ঠিক করে রাখতে রাখতে উত্তর দেয়
—গোস্সা কইরা বাপের বাড়ি চইল্যা গেছে হেয়।
রহিমের বউ পাল্টা প্রশ্ন করে.
—ভাইজান হেরে আইজ রাতেও মরছে?
ছকিনা বিবি বিরক্ত হয়ে বলে
—যাও বউ বাড়িত যাও, নিজের সংসারের কাম কাইজ করো গিয়া।
গাঁয়ে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে রাত হয়ে যায়, নিবুনিবু কুপির আলোতে মা-ছেলে খেয়ে নেয়। মজিদ খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিড়ি ধরায়, ছখিনা বিবি ছেলের উদ্দেশ্যে বলে
—অহন বাইরে যাওন দরকার নাই, কাম আছে।
মজিদের মনে পড়ে যায় আজ রাতের কাজের কথা। ঘরের পালায় হেলান দিয়ে আস্তে আস্তে বিড়ি টেনে চলে রাত গভীরের প্রতীক্ষায়।
শীতের রাতে গ্রাম–গঞ্জে রাত ১০টা না বাজতেই চরিদিকে শুনসান নিরবতা নেমে আসে। ছখিনা বিবি ঘরের কোণে রাখা খড়ের গাদা সরিয়ে রহিমার লাশটা বের করে। পুরো লাশের গায়ে লাল পিঁপড়ে ছেয়ে আছে, কোথাও হাত দিয়ে ধরার উপায় নেই। বিড়বিড় করে ছখিনা বিবি, হারামজাদী মইরাও শান্তি দিলো না।
মা-ছেলে টেনেহিঁচড়ে লাশটা বাড়ির পিছনের জঙ্গলে নিয়ে আসে, সাথে আনে এক গাদা খড় আর ছোট একটা বোতলে করে কিছুটা কেরোসিন। খড়ের গাদায় কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয় লাশের গায়ে। খড়ের আগুন কিছুক্ষণ দাউদাউ করে জ্বলে নিভে যায়। আধপোড়া লাশের দিকে তাকিয়ে ছকিনা বিবি ছেলেকে বলে, ল’ এইবার জটপট গলায় দড়ি বাইন্দা গাছের লগে ঝুলায়া দে। কাজ শেষ করে হাত-মুখ ধুয়ে নিশ্চিন্তে বাড়ি ফিরে মা-ছেলে।
ঘরে ঢুকেই ছখিনা বিবি এক খিলি পান মুখে দেয়। ছেলের উদ্দেশ্যে বলে, যা এইবার হুইত্তাপর। নাতির মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলে, হাতেমের লাইগ্যা তুই ভাবিস না আমি আছি না, এইবার তরে তিরিশ হাজার ট্যাহা লইয়া বিয়া করামু। মাগির দেমাক বাড়ছিলো—কইলাম বাপের বাড়ি থাইক্কা দশ হাজার ট্যাহা আইন্না দে, মুখে মুখে তক্ক করে, কয় পারুম না, বাপে কৈ পাইবো? এইবার মজা বুঝ, শিয়াল-শকুনে ঠুকরাইয়া ঠুকরাইয়া খাইবো।
ত্রিশ হাজার টাকা আর নতুন একটা নারী শরীরের গন্ধে নেশাখোর মজিদের চোখ জোড়া রাতের আঁধারে বিড়ালের চোখের মতো চকচক করে উঠে।
অতঃপর তাহারা
চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। ঝিঁঝি পোকার চিৎকার সেই অন্ধকারকে আরো গাঢ় করে তুলেছে। ওরা তিনজন আরো কিছুক্ষণ গাঁজা টানে। তারপর সুপারভাইজার মোবারক বললো—পাঁচ হাজার ট্যাকা কিন্তু আমি নিমু।
রশিদ আর মকবুল এক সাথে চোখ গোল গোল করে মোবারকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মকবুল কিছু বলার আগেই ড্রাইভার রশিদ বলে উঠে—ঠিক আছে নিয়েন। তয় মোবাইলডা আমিই নিমু। এইরহম একখান মোবাইল কিনুনের সখ অনেক দিনের।
কন্ডাক্টর মকবুল খরখরে গলায় বললো—ওস্তাদ মোবাইল আপনি নিবেন! মোবারক ভাই ট্যাকা, তাইলে আমি...?
—তুই আবার কী? তোর যা নিওনের তাতো নিছসই। তুই একলাই তিনবার ভোগ করছস মাইয়াডারে। আবার তারে গলা টিপা মাইরা ফেলাইছস। মনে নাই মাইয়াডা তোরে মোবাইল, ট্যাকা সবই দিবার চাইছিলো। তহন তুই তারে কী কইছিলি!
—‘এইসবে আমার দরকার নাই। আমার দরকার তোমারে। তোমার মতো সুন্দরীরে হাতের কাছে পাইয়া ছাইড়া দেওনের পোলা মকবুল না।’
পুলিশ ধরলে কিন্তু আগে ফাঁসবি তুই। একজনেরও যদি ফাঁসি অয় তাইলে হেইডা অইলো তোর।
মোবারক ধমকে উঠে—আরে ধুর বাল হইবো! লাশ এমুন জায়গায় ফালাইছি আজ রাইতেই শিয়ালে খাইয়া ফেলাইবো, কোন চিহ্নই থাকবো না।।
