অন্তরার চোখে সলিল চৌধুরী
সমাজকাল ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫:৩৬, ১৯ নভেম্বর ২০২৫
জন্ম শতবার্ষিকীতে কিংবদন্তি সুরকার সলিল চৌধুরীকে স্মরণ করলেন তার মেয়ে শিল্পী অন্তরা চৌধুরী। তিনি লেখেন- ‘দেখতে দেখতে ৩০ বছর হয়ে গেল বাবা নেই। তবু তার সুর যেন আজও আমাদের পরিবারের প্রতিটি মুহূর্তে বাজে’।
আধুনিক বাংলা গানের সুরস্রষ্টা ও গণসংগীতের প্রণেতা স্মরণীয় বাঙালি সলিল চৌধুরীর জন্ম দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার রাজপুর সোনারপুরে ১৯২৫ সালের ১৯ নভেম্বর। সঙ্গীত পরিচালক এবং গল্পকার হিসেবেও তার খ্যাতির দ্যুতি এক শতাব্দী পরে এসেও দীপ্তমান। তার সঙ্গীতপ্রতিভা মূলত ভারতীয় চলচ্চিত্র শিল্পেই ব্যাপকভাবে স্বীকৃত। বাংলা, হিন্দি, এবং মালয়ালম চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেছেন। সলিল চৌধুরী একজন আয়োজক ছিলেন এবং বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র যেমন বাঁশি, পিয়ানো, এসরাজ ইত্যাদি বাজাতে জানতেন। তার মৌলিক কবিতাগুলোর জন্যেও তিনি ব্যাপকভাবে নন্দিত এবং প্রশংসিত।
মেয়ে অন্তরার কথায়, বাবা ছিলেন অবলীলায় দুটি সত্তার মানুষ। একদিকে অক্লান্ত সুরস্রষ্টা, অন্যদিকে অনাড়ম্বর-স্নেহশীল বাবা। ছোটবেলায় বুঝতেই পারেননি বাবা এতো বড় মাপের মানুষ। কিন্তু স্টুডিওর রেকর্ডিংয়ে লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে বা মান্না দে-কে দেখে ধীরে ধীরে উপলব্ধি হয়েছিল, বাবার প্রকৃত পরিচয়।
বাড়িতে সলিল চৌধুরী ছিলেন সহজ, হালকা রসিকতার মানুষ। চুল পাকা দেখলে মেয়েকে ডাকতেন, ব্যথা পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যালান্সও নিতেন তার হাত ধরে। আবার এক পলকে হয়ে উঠতেন শৃঙ্খলাপূর্ণ গুরু- অনুশীলনে ভুল হলে ধৈর্য ধরে ঠিক করে দিতেন।
সুরের একনিষ্ঠ সাধক হলেও পরিবারকেও সমান যত্নে দেখতেন সলিল চৌধুরী। বাজেট কম হলেও ধারাবাহিক বা ছবির সুরে কখনও কাজের মান কমাননি। আবার মেয়ের রেওয়াজের সময় পাশে বসে নিজেও নতুন করে শিখতেন। বলতেন, ‘শেখার শেষ নেই মানু’।
শিশুশিল্পী হিসেবে অন্তরার গান শুরু হয়েছিল ‘মিনু’ ছবিতে। বাবার অনুপ্রেরণায় জন্ম নিয়েছিল, ‘বুলবুল পাখি’ বা ‘পুজোর গন্ধ এসেছে’, যেগুলো আজও জনপ্রিয় শিশুতোষ গান।
ইলিশ, গুলে মাছ, কষা মাংস রান্না করতে ভালোবাসতেন। নিজ হাতে বাজার করে এনে রান্না করতেন, আর সন্ধ্যায় চপ কিনে আড্ডায় বসতেন, যা নিয়ে মা-এর বকুনি, আর বাবার মজা করে উত্তর- ‘কিচ্ছু হবে না!’
আশির দশকে ডিস্কো সঙ্গীতের দাপটে কলকাতায় ফিরে এলেও কাজ কমে যায়। তবু ভেঙে পড়েননি সলিল চৌধুরী। নতুন করে নিজেকে গড়েছেন। একই সঙ্গে নিজের কাজের স্বীকৃতি না পাওয়া নিয়ে আক্ষেপও ছিল। ১৯৯২-এ পদ্মশ্রী প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। বলা যায়, তার আত্মমর্যাদা এমনই দৃঢ় ছিল।
সমসাময়িকদের নিয়ে কখনও তীর্যক মন্তব্য করেননি। আরডি-কে বলতেন ‘রিদমের উইজার্ড’, রহমানের কাজ শুনে প্রশংসা করতেন। তবে অশালীন গানের কথা তার পছন্দ ছিল না।
অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত নিজের সিরিজ ‘ইয়াদগার’-এর কাজ করছিলেন। মৃণাল সেন, হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়, অমিতাভ বচ্চন- সবাই খোঁজ নিয়েছিলেন তার শেষ অসুস্থতার সময়ে। সেসব দিনের কথা স্মরণ করতে গিয়ে আজও অন্তরার চোখে জল আসে।
অন্তরা জানান, বাবা নিজেই বলেছিলেন, ‘এখন আমাকে না বুঝলেও সময় আমাকে মনে রাখবে’। আজ জন্মশতবার্ষিকীতে তা সত্য প্রমাণিত।
অন্তরা বলেন, ‘বাবার ছোঁয়া মিস করি। রেওয়াজের মাঝে মাথায় তার হাত অনুভব করি। মনে হয়, আমার জন্ম যেন বাবার কাজ ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষণের উদ্দেশ্যেই’।
